কোষের শুল্ক গোয়েন্দা ও জহ্লাদ

দুর্গের মধ্যে তো করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ল, তারপর কী? তারপরের গল্প কিন্তু সাতকাহন। দুর্গের বিভিন্ন বাসিন্দা কী করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, ভাইরাসই বা তাদের নজর এড়িয়ে নিজের কাজ ওদেরকে দিয়েই হাসিল করিয়ে নেয়, সে গল্প বছর ঘুরলেও বলে ফুরানো যাবে না। তার সবকিছু যে আমরা জানি, তাও নয়। জানি না বলেই তো একটা ওষুধ বা টীকা বাজারে ছাড়ার আগে তা আমাদের জন্য নিরাপদ কিনা তার এতরকমের পরীক্ষা করতে হয়, যার নাম ক্লিনিকাল ট্র্যায়াল বা মানবদেহ-নিরাপত্তা পরীক্ষা। সাধারণত শতকরা ৩ ভাগের মত নতুন ওষুধ আর শতকরা ৬ ভাগের মত নতুন রকমের টীকা, গবেষণাগার থেকে সমস্ত নিরাপত্তা পরীক্ষায় পাস করে বাজারে আসতে পারে। আর সময়ও লেগে যায় দশ বা তারও বেশি বছর। মহামারীর সময় তো এত অপেক্ষা করা যায় না, এসময় বরং আমরা জোর দিই পুরানো নিরাপদ ওষুধকে কী করে নতুন করে কাজে লাগানো যায়, বা পুরানো টিকার পথ অনুসরণ করে কী করে সময়োপযোগী টিকা বার করা যায় তার ওপর। আগামী কয়েকটা লেখায় সেটাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করব খুব নির্দিষ্ট কিছু উদাহরণ দিয়ে।   

শুরুটা করা যাক আমাদের দুর্গের ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। আমাদের কোষগুলো এক একটা দুর্গের মত। আর আমাদের দেহটা এরকম অনেকগুলো দুর্গে তৈরি। একটা তফাত হল বেশ কিছুরকমের কোষ যুদ্ধজাহাজের মতন ভাসমান, শরীরের ভেতর ৭০ ভাগ জলে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবে আমাদের দুর্গ সেরকম কোষ নয়। 

গত লেখাতে যেভাবে ভাইরাসের মেমব্রেন কোষের মেমব্রেনের সাথে মিলে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছি, এটা আসলে কোষের বাইরে থেকে পুষ্টি জোগাড়ের এন্ডোসাইটোসিস নামের নিত্য-নৈমিত্তিক একটা ব্যাপার। কাছাকাছি উদাহরণ হল, ভারত থেকে আমদানির জন্য বেনাপল-হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের ট্রাকগুলোকে বাংলাদেশের অঞ্চলের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া। সীমান্তরক্ষী ও শুল্ক বিভাগ এ সম্পর্কে আগেই জানে, আমদানিকৃত সামগ্রী কোথায় যাবে। এবার ধরুন এরকম একটা ট্রাকে আসছে আমাদের করোনা ভাইরাসের আরএনএ আর সঙ্গের প্রোটিনরা। কোষের ভেতরের ট্রাক হোল এন্ডোসাইটিক ভেসিকেল যা ওই মেমব্রেন দিয়েই তৈরি করা। কোষের দেয়ালের একটা অংশ কেটে আলাদা একটা ভেসিকেল বা ট্রাক তৈরি, এবং তা দিয়ে মাল বহন করাত চাট্টিখানি কথা নয়, এ কাজের জন্য আমাদের কোষে নিয়ত লেগে আছে বিভিন্ন রকমের প্রোটিন। সেরকম একধরনের মেমব্রেন প্রোটিন পরিবার হলো IFITM প্রোটিনের সদস্য অন্তত তিন ধরনের প্রোটিন IFITM১, IFITM২ ও IFITM৩।  এদেরকে আমরা বলতে পারি শুল্ক গোয়েন্দা এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোষের লড়াইয়ের প্রথম সৈনিক। এই সৈনিকেরা এন্ডোসাইটিক ভেসিকেল বা ট্রাকের গায়ে আটকে থাকে এবং টের পেয়ে যায় ভেতরে আমদানিকৃত সামগ্রী, না পাচারকারী ভাইরাস। কী করে যে ঠিক টের পায়, তা এখনো গবেষণার বিষয়। তবে এটুকু ধারণা করা যায় যে IFITM-এর গোড়ার যে দিকটা মেমব্রেনে আটকানো থাকে, তার সাথে ভাইরাসের কোনো প্রোটিনের হয়তো গাঁটছড়া বাঁধে। ফলে ট্রাকের বাইরে IFITM-এর বাকি অংশের কম্পন বা দোলার ছন্দের পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তিত ছন্দই বদলে দেয় কোষের অন্যান্য প্রোটিনের সাথে IFITM এর ইন্টার‍্যাকশন বা গাঁটছড়া বাঁধার প্রক্রিয়া। এর বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে শুধু আমাদের গল্পের জন্য এটুকু বলি, যে এর ফলস্বরূপ ভাইরাসকে প্রথমে হাজির করা হয় থানায় বা আর্লি এন্ডোজোমে, সেই থানায় আরও অন্য কয়েদীরা জড়ো হলে তা পরিণত হয় কয়েদখানায় বা লেট এন্ডোজোমে, যেখানে হাজির হয় কোষের জহ্লাদের গাড়ি লাইসোজোম।

কোষের রাজ্যের সহজ নিয়মে এক অণুর আরেক অণুকে পছন্দ হলে, বাঁধে গাঁটছড়া না হলে দুজনে দেখে দুজনের পথ। সে রাজ্যে জহ্লাদ বা তার গাড়িটাই বা কী?

জহ্লাদের গাড়ি ওই মেমব্রেনের তৈরি একটা ভেসিকেল, যার মধ্যে জহ্লাদ হচ্ছে প্রায় ৬০ রকমের প্রোটিন যাদেরকে বলে লাইসজোমাল এনজাইম। লাইসজোমাল এনজাইমগুলো সব কাঁচি প্রোটিন, অর্থাৎ এরা অন্যান্য প্রোটিনদেরকে কেটে দেয়। যেমন প্রোটিয়েজ যা প্রোটিন কাটে, নিঊক্লিয়েজ যা বংশ বৃদ্ধির সূত্রধর আরএনএ বা ডিএনএ কাটে, কিছু কাটে লিপিড, কিছু কাটে শর্করা অণু। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব পছন্দের অ্যামিনো এসিডের ম্যুরাল আছে, যেখানে ওরা গাঁটছড়া বাঁধে, আর দুটো অ্যামিনো এসিডের মাঝে জল যোগ করে ওদের বন্ধন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরকম জহ্লাদের পাল্লায় পড়ে সমস্ত ভাইরাস কণাই পরিণত হয় ছোট ছোট টুকরোয়।

এই জহ্লাদেরা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, এদেরকে কোষের ভেতর খোলাখুলি ঘুরতে দিলে পুরো কোষটাকেই কেটে টুকরো টুকরো করে দেবে।  কোণ কারণে কোষ যদি ঠিকভাবে কাজ না করতে পারে বা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তাহলে জহ্লাদেরাই কোষের সমস্ত কিছু কুচিকুচি করে কেটে নিয়ে যায় কোষকে আত্মহত্যার দিকে।  শুধু আত্মহত্যাকারী বা জহ্লাদ বললে লাইসজোমাল এনজাইম বা কাঁচি প্রোটিনদের ঠিকঠাক চরিত্র বর্ণনা করা হবে না। কারন এই এনজাইমদের দ্বারা কাটা প্রয়োজনীয় টুকরোগুলো দিয়েই কোষ আবার তৈরি করে নতুন প্রোটিন, যেমন পুরনো শাড়ির টুকরো থেকে তৈরি হয় কাঁথা। রিসাইকেল বা ভালো ঘরণীর মত জিনিসের পুনঃব্যবহার কোষের বেঁচে থাকার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।

থানা-কয়েদখানা-জহ্লাদ, বা আর্লি এন্ডোজোম-লেট এন্ডোজোম-লাইসজোমাল এনজাইম নিয়ে গড়া ব্যবস্থা হল কোষের সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ইনেট ইমিউন রেসপন্স। কোন ভাইরাস বা বহিরাগত যদি এই ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে না পারে তাহলে এখানেই তার এবং সংক্রমণের  ইতি। করোনা ভাইরাস কিন্তু এই সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে।  লেট অ্যান্ডোজোম বা কয়েদখানার দেয়ালও কিন্তু ওই লিপিড দিয়ে তৈরি। আমাদের কোষের সব প্রত্যঙ্গের দেয়ালই লিপিড মেমব্রেন।  সজারু ও  সজারু (S1 and S2)-এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ভাইরাস একবার ইতিমধ্যে একবার সিঁদ কেটেছে ACE2-এর সাহায্যে। এই কয়েদখানার দেয়ালে ACE2-কে পাওয়া যাবে না। তা সত্বেও করোনা ভাইরাস যে এই দেয়ালেও সিঁদ কাটে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।

কী করে করোনা ভাইরাস কয়েদখানার দেয়ালে সিঁদ কাটে, তা এখনো গবেষণার বিষয় এবং সরাসরি প্রমাণ কোনো পাওয়া যায়নি। তবে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। এই ধারণা অনুযায়ী, সিঁদ কাটার জন্য ভাইরাস নির্ভর করে সেই S2 বা সজারু এর ওপরই। সজারু প্রোটিন- সখী, কত রঙ্গই জান তুমি, রঙ্গ কর দিবানিশি। কোষের মেমব্রেনে সিঁদ কাটার জন্য, সজারু প্রোটিন নির্ভর করেছিল ACE2-এর সাথে গাঁটছড়া, এর সাহায্যে  সজারু ও  সজারু-এর জোড়াতালির জায়গাটা ফিউরিন নামের কাঁচি প্রোটিনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ওপর। সজারু প্রোটিনে, বিশেষত সজারু এ, আরও একটি লুকানো জোড়াতালির জায়গা আছে। এই জোড়াতালিটা সজারু-কে কেটে আরও ছোট করে দেয়, যাকে বলতে পারি সজারু' (S2')।  লুকানো জায়গাটা উন্মুক্ত হয় চারিপাশের অ্যাসিডটি বা pH-এর ওপর। অ্যাসিডটি বা pH-কে ধরে নিতে পারি কোন তরলে কতগুলো ধনাত্মক ও ঋণাত্মক কণা আছে তার অনুপাত। যেমন pH ৭ হলে ধনাত্মক আর ঋণাত্মক কণার অনুপাতের হার সমান সমান।  আর pH ৭ এর যত কম হবে, তত ধনাত্মক কণার পরিমাণ বেড়ে যাবে,  ঋণাত্মক কণার পরিমাণ সেই অনুপাতে কমবে। সেই তরল হবে তত মারাত্মক অ্যাসিড। আর  pH ৭-এর বেশি হলে হবে এর উল্টোটা। কয়েদখানা বা লেট এন্ডোজোমে বিভিন্ন ভাগে pH ৪.৫ থেকে ৬.৫, অর্থাৎ কোথাও কোথাও বেশ অ্যাসিডিক।

চারপাশের অ্যাসিডিটি বেড়ে গেলে হাইড্রোফিলিক বা জল-ভালবাসি ঋণাত্মক পরমাণুগুলোর সঙ্গে আশে পাশের ধনাত্মক কণার আকর্ষণ বেড়ে যাবে, তার ফলে অণুর বাইরের পৃষ্ঠের হাইড্রোফোবিক ও হাইড্রোফিলিক (জল-উদাসী ও জল-ভালবাসি) পরমাণুগুলোর বিন্যাস ও বদলে দেবে। এই বিন্যাস পরিবর্তনে জোড়াতালির দ্বিতীয় জায়গাটা উন্মুক্তও হয়ে যায়। এখানে আরেকবার বলে রাখি, এটা এখনো পুরপুরি ধারণার পর্যায়ে, সরাসরি প্রমাণের জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।

কয়েদখানা থেকে এই সিঁদ কাটার পর কিন্তু ভাইরাসের আরএনএ মিশে যায় কোষের অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে এবং শুরু করে দ্রুত বংশ বৃদ্ধির কাজ। এ ব্যাপারে কিছুটা পরে বলব, বিশেষ করে রেমডেসিভির নামের যে ওষুধটা এখন কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে, সে ব্যাপারে আলোচনা করার সময়।

এর পরের লেখায় আমরা মনোযোগ দেব, কোষের থানা, কয়েদখানা হেরে গেলে, তার পরও তারা কী করে সেনাবাহিনীর সাহায্যে লড়াই চালিয়ে যায় তার ওপর। এ লেখাটা শেষ করতে চাই, এখনো সঠিক প্রমাণ ছাড়া অতিরিক্ত আশা করা হচ্ছে, যে ক্লোরোকুইন বা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নামের যে ওষুধ তার কথা বলে, কারণ কয়েদখানার সাথে ক্লোরোকুইনের বেশ যোগাযোগ।

ক্লোরোকুইন ওষুধটা বেশ পুরনো, ম্যালেরিয়া, আরথারাইটিস এর বিরুদ্ধে সফল ভাবে কাজ করে। তবে এ ওষুধ যে কোন কোন প্রোটিনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধে, তা এখনো সঠিক করে জানা নেই। এই ওষুধটা গিয়ে কোষের কয়েদখানায় জমা হয় তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্লোরোকুইন অণুটা ক্ষারীয় বা বেসিক। অর্থাৎ তরলে এটা ঋণাত্মক কণার অনুপাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এরকম অনেক ক্লোরোকুইন অণু যদি কয়েদখানায় জড়ো হয়, তাহলে কয়েদখানার ph বেড়ে যাবে, এঁর তার ফলে লাইসোজাইমের জহ্লাদেরা ঠিক করে কাজ করতে পারবে না। এটুকু আমাদের জানা। এখন এর কারণে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয়বার সিঁদ কাটা বন্ধ হয় কিনা, তা জানা নেই। টেস্ট টিউবে এটা যে SARS-CoV করোনা ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি কমায়, তা দেখা গেছে। টেস্ট টিউবের সাফল্যের পর পরীক্ষা করা হয় প্রাণীদের ওপর। ইঁদুরের ক্ষেত্রে, ক্লোরোকুইন মৃত্যুর হার কমালেও, সংক্রমণের একদম প্রথম দিন থেকে ওষুধ না দিতে পারলে কিন্তু ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি কমাতে পারেনি। আর মানুষের শরীরে সেরকম কিছু প্রমাণও আমরা পাইনি। আর করোনা ভাইরাস এত নিঃশব্দে সংক্রামিত করে, কী করেই বা বোঝা যাবে প্রথম সংক্রামণের দিন কোনটি।

SARS-CoV-২ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুদের জন্য আমরা সবাই চাতকের মত বসে আছি। কিন্তু ধৈর্য হারিয়ে মানবদেহে কার্যক্ষমতা ও নিরাপত্তার প্রমাণের আগে কোন ওষুধই ব্যবহার করা উচিত না, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

লেখক: পদার্থবিদ ও কম্পিউট্যাশনাল বায়োলজিস্ট, হ্যামিলটন, যুক্তরাষ্ট্র

এই লেখকের অন্যান্য লেখা: