হিমুর হাতে এক গাদা শপিং

আমি হাঁটছি ইডেন কলেজের সামনে ফুটপাত ধরে | জ্যামে রাস্তায় বাসগুলো স্টার্ট বন্ধ  করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে | জগলু মিয়া তারই একটাতে উঠে বোবার ভান করে বানরের মত কিছু আওয়াজ করে মানুষের সহানুভূতি কেড়ে পয়সা কামাচ্ছে | আজিমপুরের এই এলাকাটা তার দখলে |

আমি চলে যাচ্ছিলাম | হঠাৎ  তার সামনের বাসের জানালায়  মুখ গলিয়ে এক সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর বলে উঠল , হিমু দাঁড়াও ! আমি দাঁড়ালাম | রূপা | আজ প্রায় বছর দেড়েক পরে দেখা | সে নিশ্চয় এই সময়ের ঘণ্টা-মিনিটের হিসেব পর্যন্ত বলতে পারবে | তার পরনে নীল শাড়ি , কপালে ছোট সবুজ টিপ | সে কি রোজই নীল শাড়ি পড়ে ?
- কী ব্যাপার ? কোথায় যাচ্ছিলে , নেমেই বা আসলে কেন ?
- চল , কোথাও বসে চা খাওয়া যাক | 
আমি দ্বিরুক্তিমাত্র না করে ওর পিছু নিয়ে ফুটপাতের এক চা দোকানে বসলাম | এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করছি ওর মধ্যে | কপালে অস্পষ্ট রেখা জেগেছে , চোখের নিচে কালি , চুল কিছুটা মলিন | শুনেছি তার বিয়ে হয়েছে এক বিরাট ব্যবসায়ীর হাতে , যার পেটের ভুঁড়িও ব্যবসার সমানুপাতিক হারে বড় | 
- পাঞ্জাবীতে পকেট লাগিয়েছ না কি ?
- হ্যাঁ , খালার দেয়া মুঠোফোন বহনের জন্য |
- হিমু, তোমার কাছেতো কখনও কিছু চাই নি বা চাইলেও পাই নি | আজ চাইছি , দেবে ?
- হ্যাঁ , নিশ্চয় , কেন নয় ?
আমি এত সহজে রাজি হব তা হয়ত সে আশা করে নি , মুখের ভাব দেখে তা বোঝা যায় |
- তোমাকে কিছু শপিং করে দিই |
- চল | তোমার ভাবে মনে হচ্ছে আজ আমাদের প্লানমাফিক দেখা হল |
- ইনটুইশন ক্ষমতা কিছু আমারও আছে | 
- ও আচ্ছা  |
কথায় কথায় জানলাম তার স্বামী বিশেষত তার শাশুড়ি তার চাকরি করাটা পছন্দ করে না | শেষ গত সপ্তাহে এ নিয়ে স্বামীর সাথে ঝগড়া বাঁধলে এখন বাবার কাছে আছে |
সে প্রায় দশ হাজার টাকায় স্যুট-বুট , পাঞ্জাবী , হালকা কিছু কসমেটিকসসহ অনেক কিছু কিনে দিল | সে আরও প্রতিশ্রুতি নিল- এসব গায়ে চড়িয়ে কাল ধানমণ্ডি লেকে দেখা করতে হবে | আমার ইনটুইশন বলছে, সে কাল তার বাল্য বান্ধবী শিলাকে নিয়ে আসবে যার সাথে সে আমাকে বেঁধে দিতে চায় | ওর সাথে নাকি আমার বিস্তর মিল | 
আমি এক গাদা শপিং হাতে হাঁটতে লাগলাম |অনেকেই আমার দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে | আমার হাতে যেন বড় বেমানান এই শপিংগুলো | তাছাড়া পথের মানুষকেতো দেখলেই চেনা যায় |
মিনিট বিশেক দূরে ফুপার অফিস | এখন সেখানেই যাওযা যাক | আজ মাসের ৬ তারিখ | গত মাসের বেতন পাওনা পড়ে আছে | বাদলের থেকে দূরে থাকার বেতন !
আমাকে দেখেই তাঁর চশমা নাকের ওপর নেমে এল | তিনি চশমার ফাঁক গলিয়ে আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিলেন | চশমা পরেও চশমার ওপর দিয়ে দেখা মানুষদের থেকে সাবধান থাকা ভাল | এর মানে নো হাংকি-পাংকি | 
আমি যথাসম্ভব কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললাম, ফুপা কেমন আছেন ? তিনি যেন এই কথা জীবনে প্রথম শুনলেন | তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন , ভাল | তুমি কেমন আছ ?
- জানি না | আপনি বলেনতো মেডিকেল চেক আপ করিয়ে আনি ?
- না , থাক | তার দরকার নেই |
-  বাদল কেমন আছে ?
- বাদলের কথা তুমি মাথাতেই আনবে না | বেতনতো সেজন্যেই দিই না কি ?
- তা ঠিক | তবে ওর সঙ্গে মেলামেশা না করার অগ্রগতি ...
- ওর অগ্রগতি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না | আচ্ছা, এই শপিংগুলো কি বাদলের জন্য নিয়ে এসেছ ?
 - জী না | আপনার জন্য |
- আমার নুন-তেল দিয়ে আমাকেই ভাজতে এসেছ ? হিমু তুমি তোমার টাকা নিয়ে মেহেরবানি করে বিদেয় হও |
- এককাপ চা তো খাওয়ান |
- এই দুপুরে চা হবে না |
- তাহলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি |
- হিমুদের ঠাণ্ডা পানি পানের দরকার পড়ে না |
ফুপার অফিস ছেড়ে রাস্তায় নেমেছি মাত্র | এমন সময় পুলিশ এসে আমাকে তাদের ভ্যানে তুলে নিল | ফুপার বিরুদ্ধে না কি অফিসের বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাত সহ বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ উঠেছে |
ওসি সাহেব আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন, আপনার নাম?
- হিমালয়, সংক্ষেপে হিমু | তবে বর্তমান জমানা সংক্ষেপের তাই আপনি শুধু "হি" ডাকতে পারেন |
ভাবলাম তিনি এতেই রেগে যাবেন , কিন্তু না |
- বদিউল আলম সাহেবের ( ফুপা ) আপনার কিসের সম্পর্ক ?
- আমি তার ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করব না | আর এজন্য তিনি আমাকে বেতন দেন |
- তোর কী ধারণা - তুই এটা বলবি আর আমরা বিশ্বাস করে নেব ?
ওসি সাহেব আপনি থেকে তুইয়ে নেমে এসেছেন | সাবধান হওয়া দরকার |
- না করলে নাই ! তবে কথায় আছে না যে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু |
- কীভাবে বস্তু মেলে তা আমাদের ভালভাবেই জানা আছে | এই শপিংগুলো কিনেছ ছদ্মবেশ নিতে |
আমাকে ভেতরে পাঠানো হল | আমি শুধু রূপাকে এক ফাঁকে একটা কল করলাম |
ভেতরে গিয়ে দেখি কাওরান বাজারের ফর্সা মামুন | ওর বিরুদ্ধে না কি বিরোধী দলের হরতালে যোগ দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে | সে আমার গা টিপে দিতে লাগল আর মেয়েছেলের গল্প জুড়ল | 
থানা থেকে বেরিয়ে রমনা পার্কে গেলাম | একটা বেঞ্চে একটা কাপল মাখামাখি করছিল | আমি তাদের খুব কাছে গিয়ে বসলাম | তারা উঠে পড়ল | আমার হাতে তখনও শপিংগুলো | এক নিম্ন মধ্যবিত্ত দম্পতি বলল, কী আছে একটু বের করে দেখাবেন ? দেখালাম | তারা একটা টি-শার্ট পছন্দ করে দাম জানতে চাইল | আমি বললাম , নবদম্পতি হিসেবে আপনাদের জন্য আমার তরফ থেকে ফ্রি | তারা বলল, আপনাকে কে বলল আমাদের নতুন বিয়ে | 

- আমাকে যে সব খবর রাখতে হয় | 
তারা মানে মানে কেটে পড়তে পারলে বাঁচে | 
আমি আবারও হাঁটতে লাগলাম | 
সন্ধ্যার পরে শপিংগুলো রূপার তরফ থেকে তার স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দিলাম | 
পরদিন তাদের ধানমণ্ডি লেকে দেখা গিয়েছিল |
রূপার পড়নে ছিল নীল শাড়ি!