এই তো এসেছে পূজা

শরতের নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা, বাতাসে ঢেউ খেলানো কাশ ফুল, মা‌টিতে প‌তিত শিশিরভেজা শুভ্র শিউলির গৈরিক বসন যখন চোখ জু‌ড়ি‌য়ে দেয়, ঠিক তখনই কানের কাছে কে যেন বার্তা দিয়ে যায়!
এই শুনছ, মা আসছেন।
পূজার আরম্ভ মানে মহালয়া। ৯ অক্টোবর কাকডাকা ভোরে যখন মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠে‌ছি, তখন থেকেই মনে হচ্ছে পূজার গন্ধ হাওয়ায় ভাসছে। ছোটবেলা সবাই একসঙ্গে রেডিওতে মহালয়া শুনতাম।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দিনগু‌লোই দেবীপক্ষ। দেবীপ‌ক্ষে দেবীর আগমনী গানে মেতে ওঠে মানুষের মন। আর এই দেবীপক্ষ ঢাকের শব্দ, না‌রিকেলের নাড়ু, লাড্ডু, লুচি, বাহা‌রি রকমের ফল,‌ মিষ্টি, নতুন জামাকাপড়ের স্পর্শ দেয় আমাদের অস্তিত্বে।
সপ্তমীতে দেবীর চক্ষুদান দিয়ে শুরু হয় পূজার দিনগুলো। মা যেন চক্ষু মেলে নতুন করে আমাদের দেখেন। অধীর হ‌য়ে চোখের দিকে তা‌কিয়ে দে‌খি। এই চোখ সারা দু‌নিয়াটাকে দেখে রাখছে! ভাব‌তেই গায়ে শিহরণ লাগে । ষষ্ঠী পূজায় সমাদ্দারবা‌ড়ির বেলতলার পূজা আমার চিরপ‌রি‌চিত। এই বা‌ড়ির পূজা দেখেই বড় হয়ে‌ছি। দেবীর হাতে অস্ত্র দেওয়া, দেবীকে মণ্ডপে আহ্বান জানানো, নানা রকম গয়না দ্বারা স‌জ্জিত করা! দু‌লি দি‌দি আর বিপ্লব দাদুর সেই মমতা মাখা হাতে মাকে সাজানো দেখতাম।

দেবী দুর্গার সাজে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার বন্ধু শর্মিষ্ঠা সরকার।  ছবি: রুপম চৌধুরী
দেবী দুর্গার সাজে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার বন্ধু শর্মিষ্ঠা সরকার। ছবি: রুপম চৌধুরী


পূজার দিন মানেই সকালে ঘুম থেকে ওঠা। স্নান করে পূজার জন্য ফুল, বেলপাতা, তুলসী, দূর্বা সাজিয়ে পুষ্পপত্র নিয়ে মায়ের দুয়ারে​ যাওয়া। অষ্টম‌ীর দিনে অঞ্জ‌লি দেওয়া, কুমারী পূজা দেখা । সন্ধ্যায় কল্যাণ মামার সন্ধ্যা আরতী, ধূপের মাতাল করা গন্ধ যেন চৈতন্য হা‌রিয়ে দিত। ঢাকের তালে দুই হাতে ধুন‌চি নিয়ে মঙ্গল আরতীতে মেতে উঠতাম সবাই।অষ্টমী আর নবমীর স‌ন্ধিক্ষণে হয় স‌ন্ধিপূজা। ১০৮টি নীল পদ্ম খুঁজতে গিয়ে, আঁখি মেতে উঠত কবিতা বলায়। নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম বিলের জলে। মা‌টির ঢেলা দিয়ে মণ্ড বা‌নিয়ে তৈরি হতো ১০৮টি প্রদীপ। বাহা‌রি রকমের ফল কেনা হতো। সন্ধ্যায় মণ্ডপে মণ্ডপে চলত দেবী দর্শন।
দশমীতে দেবী বিসর্জনের পালা আসে। দেবীবরণ চলে, সবাই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। আবির আর সিঁদুরে রাঙা হয় সবার ললাট। মিষ্টি মুখে, ধুনচি হাতে, ঢাকের তালে তালে, জলে নিম‌জ্জিত হয় দেবী বিগ্রহ। অশ্রুসিক্ত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চোখ। তবে আবার তারা আশায় বুক বাঁধ‌েত—মা তো বছর ঘুরে আবার আসবেন। মা দুর্গার অপেক্ষায়, আর মা লক্ষ্মীর আগমনী বার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আয়োজনে।
বছর ঘুরে এই তো পূজা এসেছে। আনন্দে মেতে উঠবে মানুষ, আশীর্বাদপুষ্ট ‌হবে মানবজীবন। এত কিছুর পরেও একটা হাহাকার আসে। মা দুর্গাকে বলতে মনে হয়—হে সর্বমঙ্গলা, ছোটবেলার আনন্দটা ফি‌রিয়ে দাও! ‌ফি‌রিয়ে দাও বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, দিদার সঙ্গে চাঁদনি রাতে শিউলি ফুল তোলা, মায়ের হাতের নাড়ু খাওয়া আর পূজার দিনগু‌লোতে বা‌ড়ি থাকা। প্রশা‌ন্তির অমিয় ধারা বর্ষণ করো মানবজীবনে।

লেখক: সদস্য, গোপালগঞ্জ বন্ধুসভা। বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযু‌ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়