আমার স্মৃতির নটর ডেম: ৭০-এ পা!

‘এই যে, আপনাকে বলছি, মাথা নিচু করে অত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছেন শুনি?’ রাশভারী কণ্ঠে আমার সংবিৎ ফেরে, আমি সচকিত হই। কে কথা বলছেন! আমাদের ‘ডিরেক্টর অব গার্ডিয়ানস’, সংক্ষেপে ডগ স্যার, টেরেন্স পিনেরো। তাঁকে শুধু ভয় পেতাম বললে কম বলা হবে, পুরো নটর ডেম কলেজে এমন কলিজাঅলা কেউ ছিল না, যে কিনা টেরেন্স স্যারকে দেখলে অন্তত দুটো হার্টবিট মিস করত না। 

একেবারে অজপাড়াগাঁ থেকে আসা একটি ছেলে, যে কিনা তখনো সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়, তাঁর জন্য নটর ডেমের এই বিশাল ক্যাম্পাস রীতিমতো সমীহের ব্যাপার ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, তখনকার দিনে, প্রায় ২৩ বছর আগের সেই আমি এখনো নটর ডেম চত্বরে ঢুকলে একই রকম আপ্লুত হই। বুকের গহিনে কেমন যেন পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পাই। কারণ আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল জে এস পিশোতো এ দেশে নেই। বেশ মনে আছে, আমাদের যেদিন নবীনবরণ অনুষ্ঠিত হলো, সেদিন ফাদার পিশোতো স্পষ্ট বাংলায় বললেন, ‘দেখো মাই বয়েজ, তোমরা খুব ভাগ্যবান যে এই কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছ। এটা শুধু বিদ্যায়তন নয়; বরং এক তপোবনসদৃশ। এখানে যাঁরা পাঠদান করেন, তাঁরা শুধু শিক্ষকই নন, তোমাদের ধর্মগুরু। যতখানি পারো তাঁদের কাছ থেকে শিখে নিয়ো। পরে কাজে লাগবে।’
আমাদের ইংরেজি পড়াতেন শ্রদ্ধেয় অসিত রায়চৌধুরী। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বই পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।’ কী অমায়িক ছিলেন স্যার! আজ আমি লেখক, এই লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল আমার অসিত স্যারের হাত ধরে।
মনে পড়ে মানিক গমেজ স্যারের কথা। প্রায়ই তিনি তাঁর নাতনির কথা বলতেন। কলেজের যেকোনো অনুষ্ঠানে আমরা প্রমীলা ম্যাডামের রবীন্দ্রসংগীত শুনে সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যেতাম। কী মিষ্টি আর সৌকর্যময় ছিল তাঁর কণ্ঠ! শুনেছি ম্যাডাম নাকি অবসরে গেছেন।
ছোট ছেলে অগ্নিশের (ও সেন্ট যোসেফ হাইস্কুলের ছাত্র, বাবার মতো সে–ও নটর ডেমে পড়তে চায়) হাত ধরে কলেজে গেলাম সত্তর বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন করতে। আমাদের সময় গাঙ্গুলি ভবন ছিল না, আমরা সেখানে ডাংগুলি খেলতাম। নটর ডেম তখনো বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, আমরা বিশাল ক্যাম্পাসে চুটিয়ে ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করতাম। ন্যাচার স্টাডি ক্লাবের সদস্য হয়ে নানা রঙের প্রজাপতি ধরতে গিয়ে গলদঘর্ম হতাম। আহা, কী প্রাণোচ্ছল ছিল সেই দিনগুলো!
একবার আমাদের এক বন্ধু বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। তার উদ্দেশে আয়োজিত শোকসভায় ফাদার বললেন, ‘দেখো, তোমরা আর কখনো এ কাজ কোরো না। আমরা তোমাদের জন্য আর কাঁদতে পারব না। মনে রেখো, যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ আশা আছে।’ কাঁদলেন ফাদার পিশোতো, আমাদেরও কাঁদালেন।
ফাদার বেনেডিক্ট এম কস্তা আমাদের ইকোনমিকস পড়াতেন। ভালোবেসে বোঝাতেন অর্থনীতির জটিল সব পাঠ। অথচ একদিন সাতসকালে শুনি, ফাদার আর আমাদের মাঝে নেই। বালুবোঝাই ট্রাক স্যারকে পিষে দিয়েছে তাঁর মোটরবাইকসমেত। এবার গিয়ে দেখি সেই নাগলিঙ্গমগাছ আছে, আছে মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই গগনশিরীষগাছটাও। আমি ওদের বাকল ছুঁয়ে আদর করে দিই। মনে মনে বলি, বেঁচে থাক, বাছা! ফাদার বেনেডিক্ট বা সেই আগেবতাড়িত ‘বোকা’ ছেলেটার মতো হারিয়ে যাসনে। তোদের দেখতে না পেলে বড় কষ্ট হয় যে!
নটর ডেম! আমার প্রাণের মন্দির! যতবার যাই, মনে হয় আবার যদি কলেজকালে ফিরতে পারতাম! ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের আবাসিক ছাত্র ছিলাম, তাই ফাদারদের সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গতা ছিল কিছু বেশি। মিশনের নানান অনুষ্ঠানে তাঁরা আসতেন, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেতাম। দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। শিগগিরই ঘোষণা এল, মানবিক বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর যে পেয়েছে, সে আর কেউ নয়, এই আমি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এমাজউদ্দীন স্যারের হাত থেকে পেলাম ‘অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সেলেন্স’। চোখে অশ্রু, আমি যেন কিচ্ছু শুনতে পাইনি। মানুষের জীবনে এমন আনন্দমুহূর্ত খুব একটা আসে না।
আজ আমি লেখক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজস্ব বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্তা। অথচ আমি এখনো নটর ডেমের কাছে সেই কৈশোরকাল উত্তীর্ণ ছোট্ট ছেলেমানুষ। ছোটই থাকতে চাই। এগিয়ে যাক আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠ। যুগ যুগ জীয়ো ‘মাই নটর ডেম’! লাভ ইউ।