হেমন্তের চোখে আষাঢ়

নয়নকে ঋতু নিয়ে প্রশ্ন করলে নির্দ্বিধায় বলে দেয়, তার প্রিয় ঋতু হেমন্ত। হেমন্তকাল নিয়ে নয়ন বেশ আদিখ্যেতা করে। নয়নের জন্মদিন হেমন্তের শুরুতে। জন্মদিনকে সে হেমন্তের উৎসব ভেবে নেয়। নয়নের ধারণা, জন্ম, মৃত্যু, প্রকৃতি—এসবের একটা অদৃশ্য সম্পর্ক আছে। কয়েক মাস আগে বাল্যবন্ধু নাসিম কী একটা কাজে শহরে এসে নয়য়েন ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে এক রাত কাটিয়ে যায়। কথায় কথায় ঋতুর কথা উঠে এসেছিল। এতক্ষণে নয়ন একটা জুতসই প্রসঙ্গ পেয়ে গেল, কলেজজীবনের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন করার সুবাদে শানিত যুক্তি সঙ্গে মানবিক, সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরে নয়ন সেই রাতে রীতিমতো ভাষণ জুড়ে দিল।

হেমন্তের সঙ্গে অন্যান্য ঋতুর বিস্তর ফারাক, বুঝলি?
-কেমন? জানতে চাইল নাসিম।
যেমন ধর, বৈশাখ—বৈশাখে মহাজন সারা বছরের অনাদায় তুলে নিয়ে শূন্য করে দেয় ঋণগ্রস্তকে, আবারও ঋণের খাতা। নতুন ঋণের খাতায় নাম ওঠে। অভাবীর খড়ের চালা কালবৈশাখীর লন্ডভন্ড খেলার সস্তা উপকরণ, ঘরহীন শত আদম। গ্রীষ্ম—খাঁ খাঁ উত্তাপ, দমবন্ধ ভ্যাপসা গরমে ওষ্ঠাগত জনজীবন। ওই দিকে বিত্তশালীর শীতাতপ মেশিনে আয়েশী জীবন, স্পষ্টত ভেদাভেদ। শীতও তা–ই, বস্ত্রহীন মানুষের ঠোঁটফাটা মলিন মুখ। অথচ প্রাচীরের ওপাশে ঝলসানো মাংসের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা তন্দুরি, বৈষম্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যায়।

-নাসিম প্রশ্ন করে, তাহলে নিশ্চয়ই বসন্তকাল সর্বজনীন?
না, ভুল ভাবছিস। প্রান্তিক, স্বপ্নহীন মানুষের হৃদয়ে বাসন্তি রঙের কোনো ছোঁয়া পড়ে না। সেখানে সব রং একাকার, গাঢ় কালো। শুধু হেমন্ত ঋতুই সবার। প্রাপ্তির ঋতু, সবকিছু উজাড় করে দেয়।
একসময় নয়ন বুঝতে পারে তার প্রিয় ঋতু হেমন্তকে তুলে ধরতে গিয়ে অনেক বলে ফেলেছে।

ধুর কী সব বলে যাচ্ছি। চল, ঘুমাতে হবে বলে নয়ন আড্ডা শেষ করে। অনেক দিন বাদে দুই বন্ধু একসঙ্গে শুয়ে পড়ে। ঋতু বিষয়ে যেসব ভারী ভারী কথা নয়ন বলেছে, সে নিজেও জানে এসব চিন্তা তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। হেমন্ত প্রিয় হওয়ার আরও অজস্র কারণ আছে। সেই বাল্যকাল থেকেই এই ঋতু পছন্দের। বালিশে মাথা দিয়ে নয়নের রাজ্যের চিন্তা, স্মৃতি এসে ভিড় করে, সারা দিনের ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম নিলেও চোখ দুটো জেগে থাকে। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে নাসিম গলা পর্যন্ত কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বঙ্গাব্দের হিসাবে আর কয়েকটা দিন আছে হেমন্তের। এরপর ঋতুচক্রে শীতের আগমন। নয়নের জীবনে এবারই হেমন্তে কোনো প্রাপ্তি নেই, শুধুই শূন্যতা। পেছনে ফেলে আসা ২৮টি হেমন্ত সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পায়। উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৩১ কিলোমিটার দূরত্বের অজপাড়া গ্রামে নয়নের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেখানেই শৈশব, কৈশোরে হেমন্তকে আলাদা করে বুঝতে ও ভালোবাসতে শিখেছে।

স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা, তারপর নতুন বছর পর্যন্ত ছুটি। যতটা না পরীক্ষাভীতি, তার চেয়ে আনন্দ ছুটির জন্য। সেই ছুটির প্রত্যাশায় কাটে সারা হেমন্ত। জল সেচে মাছ ধরার শ্রেষ্ঠ সময় হেমন্ত। স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশে বই–খাতা রেখে অল্প জলে টাকি, পুঁটি, বাইনসহ নানান রকম মাছ ধরে কাদা–গায়ে বাড়ি আসা। অতি সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় সেই বয়সে হেমন্তের ধান কাটার সময় গরুর গাড়ির সঙ্গে মাঠে গিয়ে ধানের আঁটি গাড়িতে তুলে দেওয়া, ছাদসমান উঁচু ধানের স্তূপের ওপর বসে ধান চিবাতে চিবাতে বাড়ি ফেরা। সারা বাড়ি ধান ছড়ানো। বছরের শুরুতে নলীন গুড়ের সঙ্গে বাড়িতে ভাজা মুড়ি—সে এক অন্য রকম স্বাদ।

জীবনের প্রয়োজনে সেই মাঠ, পাটখেত, এঁটেল মাটির রাস্তা, বাড়ির পেছনের নদীর ঘাট ছেড়ে নয়ন প্রায় দুই দশক আগে যান্ত্রিক শহরে। সেদিনের দুরন্ত কৈশোর নয়ন আজ দীপ্ত যুবক। বয়সের সঙ্গে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, অনেক জমানো স্মৃতি আজ বিস্মৃতি। শুধু অম্ললীন রয়ে গেছে হেমন্ত। সত্য বলতে, নয়নের চোখে প্রথম কোনো মানবীকে ভালো লাগে, সেটাও প্রিয় হেমন্তে। মেয়েটির এলোচুল, নয়নের কাছে মাঠে ছড়ানো ধান। প্ল্যাগ করা ভুরুর নিচে গোটা গোটা দুটো চোখে নয়ন বাড়ির পেছনের নদীর ঢেউখেলানো জল খুঁজেছিল। তার সঙ্গে কাটানো পুরো সময় যেন বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে জল সেচে মাছ ধরার আনন্দ।

এখন হেমন্ত কাল, অথচ নয়নের চোখে আষাঢ়। বিষম দুঃখ হয়, মানবীর চলে যাওয়া কেন হেমন্তে হলো? এখন হেমন্ত আর বর্ষায় কোনো পার্থক্য নেই। পাশে শুয়ে থাকা বাল্যবন্ধু নাসিম বুঝতেই পারে না হেমন্তপ্রিয় নয়নের দুচোখ আষাঢ়ের ঢলে একাকার।

কেশবচন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঝিনাইদহ, স্নাতক পর্যায়।