কী মিষ্টি শব্দ লেবেনচুস

শিন্নি খেতে বসেছি। সুলতান ফকিরবাড়ি। তার দরগা ঘরের সামনে থেকে লোক বসেছে প্রায় গাঙের পাড় পর্যন্ত। লম্বা লাইন। দুই দিকে মুখ করে বসেছে ভক্ত-শিষ্যরা। কলাপাতায় দেওয়া হয়েছে খাবার। পাতলা খিচুড়ি। সকাল থেকেই দেখেছি ডেকচির পর ডেকচি রান্না হচ্ছে। দূরে দাঁড়াতেই সেই রান্নার ঘ্রাণ এসে লাগে আমার নাকে। 

জবাই করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ছাগল। আমি, লোটাস খাইমুদ্দিন দাদার ছেলে নূর ইসলাম।
সকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শিন্নি খাব। সবার লোভ ছিল ছাগলের মাংসের প্রতি। কার ভাগে কয় টুকরা মাংস পড়ে।
পাতলা খিচুড়িকে কলাপাতায় ধরে রাখা মুশকিল হচ্ছিল। বড় বেয়াদব খিচুড়ি। যেদিকে ঢালু সেদিকে চলে যায়। হাত দিয়ে ফেরাচ্ছি। কেউ কেউ খিচুড়ির এ অহেতুক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হাপুসহুপুস করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছে। আমি পাতলা খিচুড়ির মধ্যে মাংস শিকারের চেষ্টায় ব্যস্ত। হাতের আঙুল দিয়ে হাতড়াচ্ছি। হঠাৎ লোটাস বলল, ‘পাইছি, পাইছি’। সে মাংসের টুকরাটা তুলে ধরে দেখাল। তারপর টুপ করে মুখে পুরল।

ফকিরবাড়িতে ভক্তরা দান করত ছোট ছোট ছাগল। ছাগলের সংখ্যা হতো পাঁচ-ছয়টা। কিন্তু খাওয়ার লোকজন হতো চার-পাঁচ শ। মাংসের টুকরা করা হতো খুব ছোট ছোট।
নূর ইসলাম বলে উঠল, ‘পাইছি, আমিও পাইছি। কলিজার টুকরা।’ শেষ পর্যন্ত আমার ভাগ্যে আর জুটল না। খুব মন খারাপ হয়েছিল আমার। পাতলা খিচুড়ি খেয়ে উঠে পড়লাম।
আমাদের পাশের বাড়িই সুলতান ফকিরের বাড়ি। আমরা তাঁকে দাদা ডাকি। আমাদের সঙ্গে মজার সম্পর্ক ছিল তাঁর। দেখা হলেই ঠাট্টা-হাসির কথা বলতেন। আমার দেখা এই মানুষগুলো সবাই ছিলেন রসিক।
সুলতান দাদার বাড়িতে আছে একটি দরগাঘর। একটি টিনের ঘরের ভেতরে ছোট্ট খেলনা ঘরের মতো আরেকটি ঘর। তিনি ‘ফকির’ হিসেবে ভক্তকুলের কাছে পরিচিত।

তাঁর বাড়ির প্রধান আয়োজনটাকে বলা হয় ‘ধামাইল’। ধামাইলে ভক্তদের আগমন ঘটত। শীতকালেই হয় এটা। আয়োজনে থাকে বাঁশনাচ। লম্বা বাঁশের মাথায় বেঁধে দেওয়া পরচুলার মতো কিছু। মনে হয় মানুষের মাথা। দশ-বারোজন একেকজন একেকটা বাঁশ দুই হাতে ধরে নাচতে থাকে। ফকিরের ভক্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই বাঁশনাচ হয়।

মূল পর্বে দরগাঘর থেকে কয়েকজন বের হন। আমরা তাঁদের বলতাম ‘ভার আইছে’। তাঁরা কয়েকজন হাত-পা-মাথা কাঁপিয়ে বেড়াতেন। দরগার সামনে গোল হয়ে বসা উপস্থিত লোকজনের চারদিকে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁদের বড় বড় চোখ ছোটদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াত। ছোটরা ছিটকে দূরে সরে যেত। একজন নারী ‘ভার’ও ছিলেন। সবাই বলত ‘পাজুর মা’। তিনিও মজলিশের চারদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরতেন।

দরগার ভেতর থেকে সুলতান দাদাকে বের করতেন তিনজন লোক। দাদা থাকতেন জোড় আসন করে। তিনজন তিন দিকে ধরে তাঁকে দরগাঘর থেকে বের করতেন। তারপর ভক্তদের সামনে তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হতো।
বেজে উঠত সদানন্দ ঢুলির ঢাক, ঢোল-টিক্কারা। এই আয়োজনে আরেকজন ছিলেন। তাঁর কাঁধে থাকত একটি মোটা কাঠের লাঠি। তিনি সেটা কাঁধে নিয়ে মজলিশের চারদিকে ঘুরতেন। আমরা তাঁকে দেখে বেশ ভয় পেতাম। তাঁর হাতে আরও থাকত একটি পিতলের লোটা। সেই লাঠি আর লোটা নিয়ে তিনি ছুটে যেতেন নদীতে। নদীতে ডুব দিয়ে লোটা ভরে আনতেন পানি। তারপর শুরু হতো মজলিশের চারদিক প্রদক্ষিণ করা।

গভীর রাতে হতো ধামাইলের মূল আয়োজন। ছোট একটা পালান (ছোট মাঠ) ছিল সুলতান ফকিরের। সেই পালানের মাঝখানে কাঠের লাকড়ি সাজানো হতো। খাড়া করে সাজিয়ে রাখা হতো লাকড়ি। এ কাজগুলো করতেন ভক্তরাই। তারপর তাতে দেওয়া হতো কয়লার আগুন। শুরু হতো ভক্তদের নাচ। সেই আগুনকে ঘিরে ভক্তরা নাচ শুরু করতেন। তাঁদের মধ্যে একজন ‘মন্ত্র’ পড়াতেন। একটা মন্ত্র আমার আজও কানে বাজে।

‘এক মন ধ্যানে চায়’
সুই বিন্দে পাথরের গায়।’
এ রকম অনেক মন্ত্র পড়া হতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে লাকড়িতে আগুনের আঁচ বাড়ে। আগুন জ্বলতে থাকে দাউ দাউ করে। ভক্তরা লুঙ্গিতে কাছা মারেন। গায়ের চাদর খুলে ফেলেন। তারপর বাড়ে নাচের গতি। জ্বলন্ত লাকড়ি এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে যায়। আগুনের মধ্যেই নাচেন তাঁরা। যে বেশিক্ষণ আগুনে নাচতে পারতেন তাঁকে আমরা বীরের সম্মানে বসাতাম।

অনেক রাতে ফিরতাম বাড়িতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার যেতাম ফকিরবাড়ি। তখন দেখতাম ধামাইল মাঠের পাশে আগুনে নাচা শিল্পীরা তালগাছের নিচে শুয়ে আছেন। কারও কারও শরীরের অনেক জায়গা পুড়ে গেছে। আরেকজন এমনভাবে শুয়ে আছেন যে, তাঁর নেংটাপুটো সব দেখা যাচ্ছে। মানিক এসে বলল, ‘ওই লোকটার পুতা (অণ্ডকোষ) আগুনে পুইড়া গেছে।’

ফকিরবাড়ির পাশেই বৈরাগী বাড়ি। বৈরাগী ও ফকিরের মধ্যে একটা নীরব প্রতিযোগিতাও হতো। কোন বাড়িতে কতজন ভক্ত আসে। কোনো কোনো ভক্তকে দেখতাম দরগায়ও মাথা নোয়ায় আবার মন্দিরেও মাথা নোয়ায়। দুই বাড়িরই শিষ্য তিনি।
এবার গিয়েছিলাম গ্রামে। সুলতান দাদাকে দেখলাম লাঠি ভর দিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বললাম, ‘দাদা কেমন আছেন?’
তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। চোখে দেখেন কম, কানেও শোনেন কম।

দাদা বললেন, ‘তুমি কে?’
বললাম, ‘আমি আঞ্জুমের ভাই।’
‘আঞ্জুম কে?’
আমি এবার বললাম, ‘আমি পারুলের ভাই।’
দাদা তখন হিজলগাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চে বসে বললেন, ‘তুমার মা কেমন আছে?’
দাদার ছেলে নান্নু এখন দরগাঘরের বারান্দায় বসে থাকেন ভক্তদের আশায়।
পাশের বাড়িই আলম কাকার। তাঁর ছিল মুদি দোকান। দোকানে বসে বসে তিনি রাজ্যের গল্প শোনাতেন। সকালে তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। শিক্ষার্থীরা হাতে করে নিয়ে আসত খেজুর পাতার পাটি। সেই পাটি বিছিয়ে পড়তে বসত ছেলেমেয়েরা।

দূর থেকে শোনা যেত নামতা পাঠ।
‘এক একে এক
দুই একে দুই
দুই দুগুণে চার...’
গ্রামের মানুষ নাম দিয়েছিলেন ‘আলম সাবের পাঠশালা।’ তাঁর হাতের আঙুলগুলো ছিল অর্ধেক অর্ধেক। ইশ্, নিশ্চয় কোনো রোগে হয়তো আঙুলগুলো ক্ষয়ে পড়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ তাকে বলত, ‘টুন্ডা আলম।’ এ ধরনের শব্দগুলো হয়তো আজ আর কেউ উচ্চারণ করে না। কিছু কিছু শব্দ বিলুপ্ত হওয়া খারাপ কী! যেমন টুন্ডা। কী খারাপ কথা। তাঁর পাঠশালায় পড়ে অনেক ছেলেমেয়ে দূরের স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে ছিল শিকারীপাড়া স্কুল।
আমরা একদিন আবিষ্কার করলাম নদীর পাড়ে একটি ছোট ঘর। দৌড়ে দেখতে গেলাম ব্যাপারটা কী। দেখলাম একজন মহিলা শুয়ে আছেন। তাঁর পেট উঁচু হয়ে আছে। আরে এ যে দেখছি রামা বৈরাগীর স্ত্রী।
তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘এ্যাই পোলাপান যা-যা।’

হিন্দুবাড়ির কারও সন্তান হলে তার জন্য আলাদা করে ঘর বানানো হতো। আঁতুড়ঘর। সেই ঘরেই নবজাতকের জন্ম হতো। দুই দিন পরেই খবর পেলাম তার একটি ছেলে হয়েছে। কিছুদিন পরে আমরা জানতে পারলাম, তার নাম রাখা হয়েছে পেচাই।
পেচাই এখন পুরোদস্তুর ঘর-সংসারী। এলাকায় ব্যস্ততম কাঠমিস্ত্রি।
আলম কাকার দোকানে ছিল নানা রঙের লেবেনচুস। বয়ামে ভরা থাকত সেগুলো। আমার সৌভাগ্য হতো সেগুলো কেনার। লেবেনচুস চুষতে চুষতে বাড়ি ফিরতাম।
আহ কী মিষ্টি শব্দ লেবেনচুস।