ইয়সন মামা, ইয়স খামু

নিরঞ্জনদের রান্নাঘরের পাশে ছিল বিশাল একটি তেঁতুলগাছ। ঘন পাতায় ঝাপড়ানো সেই গাছ। আমরা সেই গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সাহস করতাম না। দিনে তো যেতামই না, বিকেল বা সন্ধ্যাবেলায় ঘুরপথ দিয়ে তেঁতুলগাছ পার হতাম।
ছোট–বড় সবারই ধারণা ছিল, তেঁতুলগাছে নিশ্চয় ভূত আছে।
ভূত না থেকেই পারে না।
সন্ধ্যাবেলায় তেঁতুলগাছের ডালে বসে ভুতুমপ্যাঁচা ডেকে উঠত।
ভুত ভুতুম, ভুত ভুতুম। এভাবে ডেকে যেত একটানা।
বাশি মিয়ার ছিল দুনালা বন্দুক। তিনি যেতেন পাখি শিকারে। পেছন পেছন ছুটত তাঁর ছেলে মাহবুব। গ্রামের আরও দু–একজন বাশি মিয়ার পেছন পেছন ছুটত।
বিকেলের কচুরিপানার ওপর নানা পাখি খাবারের সন্ধানে আসত। সাদা-বকগুলো সার বেঁধে বসত। আর অমনি বাশি মিয়া পাখির ওপর গুলি চালাতেন। কত রকমের পাখি যে তিনি শিকার করেছেন তার ইয়াত্তা নেই। সেই পাখি মেরে পাখির ঠ্যাংগুলো ধরে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যেত মাহবুব।
ছোটরা দেখতাম বাশি মিয়ার বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে পাখির ফইরে (পালক) ভরে গেছে। আমরা দূর থেকে পাখির মাংস রান্নার খুশবুও পেতাম। আমাদের গ্রামে একমাত্র বাশি মিয়ারই বন্দুক ছিল। গ্রামে আর কেউ বন্দুক ব্যবহার করত না।
আলী হোসেন বিশ্বাসের (মসজিদের ইমাম) আগে মসজিদের ইমামতি করতেন মোহন বিশ্বাস। তিনি ছিলেন মোটাকাটা। বেশ নাদুসনুদুস। আমার ছোটবেলায় দেখা বয়স্ক লোকেরা প্রায় সবাই ছিলেন রসিক। মোহন দাদাও ছিলেন রসিক। মজা করতেন। হেসে হেসে কথা বলতেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আলী হোসেনের এক ছেলেকে পালতেন তিনি। তিনিই আমাদের রুম মামা। তাঁর কথা দু–একবার বলেছি।
দাদার ছিল মাছ ধরার নেশা। আমরা ভোরবেলা দেখতাম টাকি মাছের পোনা ধরে তিনি মাটির কোলায় বা হাঁড়ি ভরে নিয়ে যাচ্ছেন।
বর্ষাকালে তিনি ধরতেন ঘাউড়া মাছ। দূরে কোথাও নদীতে চলে যেতেন। বুঝতে পারতেন কোথায় ছিপ ফেললে মাছ ধরা যাবে। ঘাউড়া মাছের বড়শির আদার ছিল মুরগির নাড়িভুঁড়ি। সে সময় মুরগি জবাইটবাই সাধারণত হতো না। যদি কারও বাড়িতে মেহমান আসত কেবল তখনই মুরগি জবাই হতো। মোহন দাদা খোঁজখবর রাখতেন কোন বাড়িতে মেহমান আসছে। মেহমান এলেই তিনি সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতেন। আমাদের বাড়িতে তাঁকে অনেকবার দেখেছি মুরগির নাড়িভুঁড়ি নিতে এসেছেন। নাড়িভুঁড়ি পেলে তিনি বেশ খুশি হতেন। চলে যেতেন ঘাউড়া মাছ ধরতে।
আমার দাদারও নেশা ছিল মাছ ধরার। মাঝেমধ্যে তিনিও যেতেন মাছ ধরতে। ধরে নিয়ে আসতেন বড় বড় তেলওয়ালা ঘাউড়া মাছ। মাছ ধরে বাড়িতে ফেরার পথে মাছের পেটের সব কিছু পরিষ্কার করে আনতেন। ঘাউড়া মাছ যেহেতু ঘু খায় তাই এই ব্যবস্থা। মাছটা একটু টেকনিক করেই পরিষ্কার করে বাড়িতে আনতেন। আমার ছোট ফুফু মনে করতেন ওই মাছের পেটে আসলে কিছু থাকে না। অনেক পরে ছোট ফুফুর ভুল ধারণা ভেঙেছিল।
নানা রকম শস্য ফলত গ্রামে। মটরশুঁটি, খেসারি, কলাই, ছোলা, গম, তিল, তিসি আরও কত কিছু। আমরা মটরশুঁটির খেতের পাশ দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় মটরশুঁটি তুলতাম। তারপর সেগুলো খেতে খেতে স্কুলে যেতাম। কখনো কখনো গম বা পায়রার ডগা ছিঁড়ে তিরের মতো ছুড়ে দিতাম শূন্যে।
একটা আনন্দের আয়োজন ছিল ‘ছোলা পোড়া’ বা কলাই পোড়া খাওয়ার ব্যাপার। নাড়ার আগুনে আমরা কলাই পোড়া দিতাম। পোড়া শেষ হলে আমরা ১০–১২ জন গোল হয়ে বসতাম। তারপর খুঁটে খুঁটে সেগুলো খেতাম।
নদীর ওপারে কাউনিয়াকান্দি গ্রামে হতো ছোলার চাষ। আমাদের এপারের কয়েকজন ছিল ছোলাগাছ চুরিতে এক্সপার্ট। তারা নদীর হাঁটুপানি ভেঙে ছোলা চুরি করে আনত। তারপর সেগুলো পোড়ানো হতো। গোল হয়ে বসতাম আমরা। খাওয়া শেষে একটা দুষ্টুমিও হতো মাঝেমধ্যে। হয়তো একজন কারও মুখে পোড়া ছাই মেখে দিয়েছে—আর যায় কোথায়, শুরু হতো পরস্পরের মুখে ছাই মাখানোর প্রতিযোগিতা।
আমরা মাঝেমধ্যে সুলতান ফকিরের শিষ্য হয়ে যেতাম। তাঁর বাড়ির পেছনে ছিল বিশাল জঙ্গল। আমরা কেউ যদি তাঁকে গিয়ে বলতাম দাদা, ‘খবর খারাপ। জঙ্গলে বাগডাশ দেখা গেছে। আর কথা নেই। তিনি লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে বের হতেন। লোটাসদের ছিল একটি কালো কুকুর তারও ছিল মহা উৎসাহ। গ্রামের ২০-২৫ জন ছেলে মুহূর্তে জড়ো হয়ে যেতাম জঙ্গলের চারদিকে। চারদিকে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে হইহই করে উঠতাম। আর অমনি লোটাসদের কুকুরটা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যেত। ঘেউ ঘেউ করে তন্নতন্ন করে খুঁজত কোথায় বাগডাশ বা শিয়াল আছে। সুলতান দাদা বলতেন, ‘দেহিস কোন দিক দিয়া শালায় বাইর হইয়া যায়।’
আমাদের শতক চোখ পাহারা দিত। আমরাও কাঠ বা ডাল দিয়ে জঙ্গল পেটাতে থাকতাম। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করে উঠত। ‘অ্যাই বাইর অইছে।’ আর আমরা ছুটতাম শিয়াল, খাটাশ বা বাগডাশার পেছন পেছন। এক গ্রাম থেকে কোনো কোনো সময় আরেক গ্রামে চলে যেতাম। কখনো কখনো আমাদের শিকার বড় কোনো জঙ্গলে ঢুকে যেত। সেটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। কখনো–বা প্রাণীটাকে সুলতান দাদার হাতে প্রাণ দিতে হতো।
একদিন সকালে উঠে হইচই শুনতে পেলাম। ঘটনাটা বোঝা গেল একটু বাদেই। রেণু আপাদের বাসায় চুরি হয়েছে। মানে আমার চাচার বাড়ি। আমরা ছুটে গেলাম। দেখি সিঁধ কাটা। মাটি কেটে ঘরে চোর ঢুকে সব নিয়ে গেছে। আমার চাচির সে কী কান্না! আমার চাচির বাড়িতে বছরে একবার চুরি হতোই। গ্রামের অন্য দু–এক বাড়িতে চুরি হতো। সব বাড়িরই ঘরের ভিটি ছিল মাটির। চোরেরা পিরা (ভিটি) কেটে ঘরে ঢুকে চুরি করত।
পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল কারা চুরি করে বা কে চুরি করায়। সে কথা অবশ্য এখানে বলা যাবে না। যিনি চুরি করাতেন তাঁর বংশধরেরা এখন বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।
সুজাপুর গ্রামে ছিল একজন মৌলভি সাহেব। আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছেন মিলাদ পড়াতে। তাঁকে কেউ কেউ বলতেন, ‘তিন মাথাওয়ালা মৌলভি। তাঁর মাথাটা ছিল অস্বাভাবিক রকমের বড়। তাই এই নাম। তিনি নিজেও জানতেন এই কথাটা। কিন্তু তাঁদের কাউকে কখনো কোনো কটু কথা বলেননি। খুব দ্রুত কথা বলতেন। তাঁর একটি ভিন্ন রকমের গুণ ছিল। তিনি মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারতেন।
একদিন দাউদপুর বাজার থেকে ফিরছি। খালুইতে মাছ–আনাজ। পথে তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী মাছ কিনলা?
বললাম, রয়না।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছড়া বানালেন,
মাছের নাম রয়না
ঠাকুর ছাড়া খায় না।
ছড়াটা বলেই তিনি শিশুর মতো খলখলিয়ে হাসতে লাগলেন।
শীতকালে খুব ভোরবেলা উঠতাম আমরা। সঙ্গে থাকত আমার দুই ভাগনে পাশা (আরিফুর রহমান) আর সোহেল (আশিকুর রহমান)। সোহেল এখন সপরিবারে কানাডাপ্রবাসী। আমাদের খেজুরগাছ ঝুড়তেন (গাছ কেটে রস বের করার প্রসেস) ডাউরি দেওয়ান নামের একজন। গাছের নালে (যেটা বেয়ে রস পড়ে) ঝুলিয়ে দেওয়া হতো রসের হাঁড়ি (একরকম মাটির পাত্র)। ভোরবেলা এসেই তিনি, ডাকতেন, ‘এই নস (রস) নেন, নস।’ রসকে তিনি বলতেন নস। গাছে উঠে রস ভরা হাঁড়ি নামাতেন। তারপর দুই ভাগ করা হতো রস। এক ভাগ আমাদের, আরেক ভাগ গাছি ডাউরি দেওয়ানের।
সকালবেলাতেই আমরা সেই রসে চুমুক দিতাম। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সেই রস খাওয়া! জিহ্বা কেমন তোলপাড় করছে! সোহেল বলত, ‘ইয়সন মামা, ইয়স খামু’ (রওশন মামা রস খাব)। একটু রোদ উঠলেই সেই রসের চা বানানো হতো। চায়ের সঙ্গে মুড়ি। চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাওয়া।
সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে আমরা বসতাম। আমাদের সামনে বসে থাকত আমাদের কুকুর ট্যারো। আমরা তাকে খেলার ছলে ভাজা মুড়ি সামনে ছিটিয়ে দিতাম। সে জিভ বের করে ধুলো থেকে চেটে নিত মুড়ি।