দাদি যখন ভাবি

প্রত্যেক গ্রামেই মনে হয় কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের খেপিয়ে অন্যেরা মজা পায়। আমাদের গ্রামেও এমন বেশ কয়েকজন ছিল।
এক. হাতেম আলী
তিনি ছিলেন অবিবাহিত। একা একাই রান্নাবান্না করে খেতেন। আড়ালে–আবডালে তাঁকে নিয়ে চলত নানান রকমের মুখরোচক আলোচনা। কীভাবে কেমন করে তাঁর একার সংসার চলত, জানতাম না। তাঁকে কোনো কাজ করতে দেখিনি। কারও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না, তাঁকে খ্যাপানো হতো হাতেম আলী বলে। অনেকে বলত, ‘কিরে হাতেম হতে চাস নাকি?’ গ্রামের বড়রা হাতেমকে দেখে বলত, ‘কী হাতেম চাচা বিয়া করবেন কবে?’ এ কথা শুনে হাতেম খেপে যেতেন।
বর্ষার দিনে একটি ‘চারি’ নিয়ে তিনি এদিক–সেদিক যেতেন। মাটির বিশাল একটা পাত্রকে বলা হতো চারি। সেটার মধ্যে বসে একটি বইঠা বেয়ে এবাড়ি–ওবাড়ি যেতেন তিনি।
দুই. মেহের আলী
মেহের আলী খুব একটা কথা বলতেন না। আলাভোলা। তাকে খ্যাপাতে চেষ্টা করলে গালিগালাজ করতেন। তাঁর নামে অভিযোগ ছিল তিনি গ্রামে চুরিচামারি করতেন। তাঁদের সংসারের অবস্থাও ভালো ছিল না। তিনবেলা যে পেটপুরে ভাত খেতে পারতেন, তা–ও না। ছোটবেলায় দেখেছি অনেকবার গ্রামের লোকজনের হাতে তাঁকে মার খেতে। কেউ যদি কাউকে খ্যাপাতে চাইত, তাহলে তাঁকে বলত মেহের।
তিন. বুবি
কাঠেরপুলের বাঁ পাশে সন্তোষ কাকার বাড়ি। সন্তোষ শব্দটা হয়তো হয়ে গিয়েছিল সাইন্তা। সাইন্তার বাড়ি, ‘সাইন্তার বইন বুবি’ ইত্যাদি বলত লোকজন। বুবি মানে বোবা। তাদের বাড়িতে ছিল বেশ কিছু গরু। বুবিই সেগুলো লালনপালন করতেন। গরু নিয়ে মাঠে যাওয়া, গরুর জন্য ঘাস কাটা, গরু নদীতে নিয়ে ঝাঁপানো সব। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। দেখেছি কতজন তাঁকে দেখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করত। তাঁর হাতে সব সময় থাকত একটি কাঁচি। এ ধরনের অঙ্গভঙ্গির কারণে তিনি কাঁচি নিয়ে দৌড়াতেন। আর ছেলের দল দৌড়ে পালাত।
চার. ফরু ভাই
ফরু ভাইকেও মানুষ খ্যাপাত। তাঁর একটা হাত ছিল অবশ। সেই এক হাত দিয়ে তিনি নৌকা বাইতে পারতেন। টিউবওয়েল থেকে কলস ভরে পানি নিতে পারতেন মাথায় করে। এই মানুষগুলোকে অন্যরা স্বাভাবিক চোখে দেখত না। গ্রামের কিছু বেগার লোক খুঁজে বেড়াত, এদের ত্রুটি। এরা যেন ছিল গ্রামের মানুষের বিনোদনের অংশ।
পাঁচ. নান্নু
নান্নু ছিল সারা গ্রামের মানুষের কাছেই আলোচিত। অল্প বুদ্ধির ছেলে। আমার মনে হতো সারা দিনই যেন তার ক্ষুদা লেগে থাকত! সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াত। কোথায় কী হয়, সেটা তার দেখা চাই। পুকুরে মাছধরা, বা হালটে মার্বেল খেলা সব জায়গাতেই তাকে পাওয়া যেত। আর তাকে নিয়ে ছেলেমেয়েরা মজা করত। আর খেপে গেলে একটা বাজে গালি দিয়ে সে দৌড়ে পালাত।
গ্রামে এক মহিলা ছিলেন। তাঁকে আমরা ডাকতাম গেদি ফুফু। কেউ কেউ তাঁকে বকরিওয়ালীও ডাকতেন। অনেকগুলো ছাগল (বকরি) পালতেন তিনি। গেদি ফুফু ছিলেন বিধবা। নিঃসন্তান। মুরগিও পালতেন। কোনো রকমে তাঁর দিন চলত। তাঁর ছিল একটা একচালা ঘর। আর ঘরের বেড়া ছিল পাটখড়ি দিয়ে ঘেরা। মাটির পাতিলে তিনি রান্না করতেন। কত আয়োজন করে রান্না করতেন। কখনো কখনো মনে হতো, তাঁর সঙ্গে বসে ভাত খাই। আমাকে দেখে বলতেন, ‘কী নাতিন জামাই ভালো আছনি?’ জামাই শব্দ শুনে আমি দৌড়ে পালাতাম।
রকিব ভাইয়ের বাবা ছিলেন স্টিমারের সারেং। অনেক দিন পরপর তিনি বাড়িতে আসতেন। একদিন রকিব ভাইদের পুকুরে মাছ ধরতে বসেছেন আমার বড় দুলাভাই (আজিজুল হোসেন খান)। বড়শির ছিপ নিয়ে বসেছেন রকিব ভাইয়ের বাবাও। আমি দুলাভাইয়ের জোগালির কাজ করছি। এটা-সেটা এগিয়ে দিচ্ছি। বড়শির আধার ছিল সম্ভবত ছোট চিংড়ি মাছ।
রকিব ভাইয়ের আব্বা। আমরা তাঁকে কাকা ডাকতাম। তিনি আমার কাছে একটি ছোট চিংড়ি মাছ চাইলেন। আমি একটি চিংড়ি বাঁ হাতে ধরে তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি ভীষণ খেপে গেলেন। বললেন, ‘ছি. ছি.। কিছু শিখো নাই দেখছি। কিছু দিতে অইলে যে ডান হাত দিয়া দিতে হয় তা–ও জানো না!’
ডান হাত আর বাঁ হাতের পার্থক্য যে আলাদা হতে পারে, সেদিনই বুঝলাম। ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। দুলাভাই চুপ করে থাকলেন। কিছু বললেন না। আমার লজ্জা পাওয়া দেখে মনে হয় তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন।
আহমদ ভাই ছিলেন এক মজার মানুষ। সংসারে তাঁর বদনাম ছিল। কারণ, তিনি কোনো রোজগার করতেন না। ঘুরেফিরে সময় কাটাতেন। দূর থেকে আমরা তাঁর হো হো হাসির শব্দ শুনতে পেতাম। নাম দিল আহম্মদ। তা থেকে আমোদ। বড্ড আমুদে লোক ছিলেন। কেউ কোনো বিপদে পড়লে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তাঁর সঙ্গে আমরা বেশ কয়েকবার ঢাকা গিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের চরনদার (গাইড)। তাঁর সঙ্গে গিয়ে আমরা ঢাকার দয়াগঞ্জে উঠতাম আনা (অইনুল হক) মামার বাসায়। জীবনের প্রথম বাকরখানি খাওয়া সেই বাসা থেকে।
ওইবারই কি? না, হয়তো পরেরবার। আমরা পুরো পরিবার একটি গ্রুপ ছবি তুলেছিলাম স্টুডিওতে গিয়ে। সে ছবিটা এখনো আছে। ঘোড়ার গাড়িতেও চড়েছিলাম। আর কী কী দেখেছিলাম ঢাকায়, সেসব আর মনে নেই।
সন্ধ্যার পরই গ্রামে শিয়ালের ডাক শোনা যেত। হু–হুক্কা হুয়া। সেই শব্দ শুনে মায়ের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে পড়তাম। কেমন ভয় ভয় করত।
কোনো কোনো দিন দূর থেকে ভেসে আসত ঢোল-করতালের শব্দ। বড় সড়কের পাশে ছিল একটি বিশাল হিজলগাছ। গভীর রাতে ঋষিরা বসত সেই গাছের নিচে। সারা রাত চলত তাদের গানবাজনা।
আমরা ছোট দাদিকে বলতাম ভাবি। বাড়ির কঠিন কঠিন কাজ করতেন তিনি। দূরে কোনো কাজে যেতে হলে তিনিই ভরসা। হয়তো যেতে হবে আমার বড় ফুফুর বাড়ি বেনুখালী অথবা ছোট ফুফুর বাড়ি সিংহরা। তিনি হাতে একটা ছাতা নিয়ে রওনা দিতেন। কোমরে একটি নেকড়ায় বাঁধা থাকত পান-সুপারি। রাস্তায় জিরিয়ে জিরিয়ে তিনি দিব্যি চলে যেতেন সেসব জায়গায়। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে।
আমিও একবার ভাবির সঙ্গে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম জনট্রাইল নামে একটি গ্রামে। আমাদের গ্রাম থেকে সেটির দূরত্ব ছিল প্রায় ১০ মাইল। ভাবি খালি পায়ে হাঁটতেন। ওই গ্রামে ছিল মায়ের বান্ধবীর বাড়ি। আমরা বলতাম ঠাণ্ডা খালা। অবশ্য বর্ষার মৌসুমে নৌকা করে যেতাম খালার বাড়িতে।
মেট্রিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো নবাবগঞ্জে। বকচর থেকে অনেক দূর। খালার বাড়ির কাছেই ছিল পরীক্ষাকেন্দ্র। নদীর ওপারে। নাজু আপা, আঞ্জুম ভাই-পুলক ভাই সবাই সেই বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
বাড়িতে কোনো বিয়েশাদি হলে রং ছোড়াছুড়ি হতো। হতো কাদা ছোড়াছুড়ি খেলা। কাদা ছোড়াছুড়িতে ভাবি থাকতেন টার্গেটে। একবার নাজু আপার বিয়েতে কাদায় ভরে গেল উঠোন। ভাবি আর শামসু (শামসুল আহমদ) দুলাভাইয়ের সঙ্গে কাদা খেলার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। উঠোনের চারদিকে দাঁড়িয়ে অনেক দর্শক। এমনভাবে পরস্পর পরস্পরকে কাদা মাখাতে লাগলেন যে, তাঁদের শরীর কাদায় ভরে গেল। তাদের আর চেনাই যায় না।
বরযাত্রীদের লোকজনের মাথায় গোপনে কেউ কেউ রঙের গুঁড়া ছেড়ে দিত। আস্তে আস্তে দেখা যেত তার সাদা পোশাক লাল হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিয়েবাড়িতে কেওয়াজও কম হতো না।
আমাদের ছিল কাঁচা পায়খানা। ঘরের বাইরে। রাতে বাথরুম করার প্রয়োজন হলে আমরা ভাবিকে ডেকে তুলতাম। ভাবি দরজা খুলে দিতেন। হারিকেন বা কুপিবাতি নিয়ে দরজার সামনে বসে থাকতেন। বাথরুম করে আসার পর তিনি শুতে যেতেন। কিছুক্ষণ পর হয়তো আবার কোনো ভাইবোনের বাথরুম পেয়েছে, আবার তাঁকে দরজা খুলতে হতো। আবার তিনি দরজার সামনে বাতি নিয়ে বসে থাকতেন। আবার কোনো কোনো ভাইবোনের এত ভয় ছিল যে পায়খানার সামনে ভাবিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আহ্ কত কষ্ট দিয়েছি আমরা তাঁকে।
তাসুল্যা থেকে গয়টা (গোবর শুকানো একধরনের জ্বালানি) কিনে আনতেন। হাটবাজারেও যেতেন।
একবার ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের পা ভেঙে যায়। হাঁটুর বাটি ডিসপ্লেস হয়ে গেল। সে সময় মায়ের সব রকম সহযোগিতা করেছেন ভাবি।
মা-ই আমাদের বলে দিয়েছিলেন দাদিকে ভাবি সম্বোধন করতে।