চীনকে চিনি-২

চীনকে চিনি-২
চীনকে চিনি-২


দেড় বছর আগে আমি যখন চীনে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে পা রাখি, তখন একেবারেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। দেশে বসে যেমনটা কখনো ধারণাতেই ছিল না। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী ভাষা–সংস্কৃতি আলাদা হবে, সেটা জেনে এসেছিলাম। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপেই একজন বিদেশি হিসেবে নিজেকে শিশু মনে হবে, সেটা একটু বাড়াবাড়ি। কিছুদিন যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম, আমি কিছুটা হতাশ এবং বিরক্ত। বাংলাদেশের ছোট্ট একটা পাহাড়ি শহর বান্দরবানের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল তার অলিগলির কথা, বন্ধুদের কথা। মায়ের মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। আম্মুকে ফোন করি, বন্ধুদের ফোন করি। কথায় কথায় এই আজব দেশের গল্প জুড়ে দিয়ে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করি। গল্পগুলোর কিছুটা এখানে তুলে দিই।

চীনকে চিনি-২
চীনকে চিনি-২


চীন হলো স্বাভাবিক পৃথিবীর ভেতর একটি অস্বাভাবিক রাজ্য। চীনে থাকা মানে চীনেই থাকা। পৃথিবীতে থাকা নয়। এরা পৃথিবীর ভেতর ভিন্ন পৃথিবী তৈরি করে রেখেছে। সেখানে তারা বাইরের পৃথিবীর সবকিছু জেরক্স করে রেখেছে নিজেদের ব্যবহারের জন্য নিজেদের মতো করে। কিছুরই কমতি নেই; বরং একটু বেশি বেশিই। আমরা সারাক্ষণ সমস্যার সমাধান খুঁজি গুগলে বা ইউটিউবে। এগুলোতেই আমরা অভ্যস্ত। এই অভ্যস্ততা থেকে বেরোনো বেশ কষ্টের। চীনে গুগলের প্রবেশ নিষেধ। গুগল ছাড়াও আমেরিকান জনপ্রিয় অনেক ওয়েবসাইট এখানে নিষিদ্ধ। গুগল নেই তো সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে পাইদু আছে, থ্রিসিক্সটি আছে, পিং আছে। ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম নেই তো ইউখোও, ওয়্যাপও,আইছিই, পিল্লিপিল্লি, কিউকিউ, উইচ্যাট আছে। এগুলোতে চাইনিজরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করছে। দুনিয়ার সব কাজ তারা এসব দিয়েই সারে। এমনকি আপনার কেনাকাটার জন্য পকেটভর্তি করে টাকা নিয়ে ঘোরার কোনো প্রয়োজন নেই। উইচ্যাট বা আলিপে দিয়ে আপনি কেনাকাটার কাজ সারবেন। এক খিলি পানও আপনি মোবাইলে কিনে চিবুতে পারেন (যদিও চীনে পান নেই)। চীন মোবাইলে লেনদেনের ধারণাটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যান্য দেশ এখন এই পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। চীন জীবনযাত্রাকে সহজ করার জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে পৃথিবীকে তাক লাগাতেই আপাতত ব্যস্ত। প্রায় দেড় শ কোটি মানুষের দেশের এই ভূখণ্ডে যেটাই আনা হচ্ছে, অল্প কয়েক বছরে ফুলেফেঁপে উঠছে। থাওপাও, আলিবাবা, পিংত-ত,টি-মল—এসব ই-কমার্স সাইট কোনো অংশেই পৃথিবীর অন্য বাঘা বাঘা সাইটের চেয়ে পিছিয়ে নেই। এর মূল কারণটাই হলো চীনের বিশাল জনগোষ্ঠীই এদের ব্যবহারকারী।

আরেকটা মজার বিষয় হলো আপনি বাংলাদেশ থেকে আসছেন—এই কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুললেও তারা বুঝবে না। তাদের বলতে হবে আপনি ‘মংচিয়ালাকুয়া’ থেকে এসেছেন। তাহলেই বুঝবে, ওমা! তুমি তো প্রতিবেশী কুয়া থেকে এসেছ! (কুয়া মানে আপনি যেটা ভেবেছেন, সেটা না। এর মানে দেশ)। শুধু বাংলাদেশ না, তারা প্রতিটা দেশের নামই দ্বিতীয়বার রেখেছে নিজেদের মতো করে এবং এ নামেই তারা চেনে। পৃথিবীর মানুষ কী নামে ডাকে, তার দরকার তাদের নেই।
দেশের নামের উদাহরণ দিই, বাংলাদেশ-মংচিয়ালাকুয়া, ইন্ডিয়া-ইন্তুকুয়া, অস্ট্রেলিয়া-আউতিলি, আমেরিকা-মেইকুয়া, ব্রাজিল-পাশি, ফ্রান্স-ফাকুয়া, নেপাল-নিপৌয়ার, স্পেন-শিপানিয়া, নিউজিল্যান্ড-শিনশিলান। দেশের নাম শুধু নয়, চীনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও একটি নতুন নাম পাবেন। আমার নামটা এখানে বলব না। আমার দুষ্টু বন্ধুরা ওই নামে ডাকা শুরু করলে আমি সহ্য করতে পারব না। বড়ই অদ্ভুত নাম। নামের কিছু উদাহরণ দিই, আজাদ-আ চা’আর, ইয়াসমিন-ইশামিং, বশির-পাশাআর, করিম-খ উলি'ম, আসমা-আ’শিমা। চীনে এসে আপনার নাম কী হতে পারে, ভেবে নিয়ে বেশ আনন্দ নিতে পারেন।

খেলাধুলা বিষয়ে একটু বলি। আমরা ক্রিকেটপাগল দেশের মানুষ। আমাকে বলা হলো তোমার প্রিয় খেলা কী? আমি অকপটে বলি ক্রিকেট। আশ্চর্যের বিষয় হলো ক্রিকেট চীনারা চেনে না। চেনে, তবে অন্য নামে। ক্রিকেট মানে চীনাদের কাছে ঝিঁঝিপোকা। তারা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকায়, যেন ভাবে, ঝিঁঝিপোকা দিয়ে এমনকি খেলা আছে, যেটা তার এত প্রিয়! ইন্টারনেট ঘেঁটে ক্রিকেট খেলার ছবি দেখাতেই তারা বলে, ওহ! এটা তো ‘পান চিও’। আমরা এটা খেলি না। চীনাদের প্রিয় খেলাই হলো ফুটবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিলটেনিস—এসব। চীনারা নিঃসন্দেহে খেলাধুলাপ্রিয় জাতি। খেলাধুলার কিছু না পেলে তারা মোবাইল বা কম্পিউটারে গেম খেলে হলেও অবসর কাটাবে।
অবসরে চীনারা কী করে, তার একটা তালিকা আমি করেছি। আপনাদের জন্য আরেক দিন সেই গল্প লিখে ফেলব।

কুনমিং, চীন