রাজশাহীর দুর্গম চরে বন্ধুসভার নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্বোধন

‘ভাঙনে ভাঙনে অনেকটা ভারতের ভেতরে ঢুকে গেছে পদ্মা নদী। ওই দিক দিক দিয়েই নৌকা নিয়ে যেতে হবে। নৌকায় প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছেন একজন মা। বিএসএফ এই মায়ের যন্ত্রণা আর বুঝতে পারে না। তারা নৌকা ঠেকিয়ে দেয়। শেষমেশ নৌকার ভেতরেই সন্তান প্রসব করেন মা। এই হচ্ছে চরখিদিরপুর গ্রামের মানুষের নিয়তি। গ্রামের তিন দিকে ভারতীয় সীমান্ত আর একদিকে পদ্মা নদী। সেখানেই প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে আয়োজিত মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে এই গল্প শোনালেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম।

এই গ্রামে কোনো চিকিৎসক নেই। নেই সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকও। রাজশাহীর সেই চরখিদিরপুরেই গত রোববার নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্বোধন করা হলো। শতভাগ বাল্যবিবাহের এই চরেই প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত আলোর পাঠশালা রয়েছে। পাঠশালার মাঠেই এই মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. নওশাদ আলী, অতিথি ছিলেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুর রহমান, রাজশাহীর পবা উপজেলার চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম, রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রাশিদা খাতুন।

রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি ফারুক হোসেনের পরিচালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই মেডিকেল ক্যাম্প ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গোড়ার কথা বলেন, প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ও আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক রেজিনা খাতুন।

লন্ডনপ্রবাসী চিকিৎসক রাজিয়া খাতুন এই দুর্গম এলাকায় চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রথম আলো রাজশাহী বন্ধুসভাকে ইতিমধ্যেই এক লাখ টাকা দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে ইউপি চেয়ারম্যান মুফিদুল ইসলাম প্রতিবছর তার পরিষদ থেকে এই মেডিকেল ক্যাম্পের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দেন।

সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত প্রায় ৩০০ রোগীকে চিকিৎসা দেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষসহ ১০ জন চিকিৎসক। তাঁরা হলেন মো. গোলাম মোস্তফা, ইসমাইল হোসেন, রাকিব হোসেন, তন্ময় হক, ইকবাল হাসান, সুভাশীষ দাশ, সাদিয়া শারমিন, জান্নাতুল ফেরদৌস ও আফরিনা আজাদ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ নওশাদ আলী বলেন, তাঁর ধারণাই ছিল না যে রাজশাহী শহরের পাশেই এমন একটি জনপদ রয়েছে, যেখানকার মানুষের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। নদীর ওপারেই রাজশাহী শহরে কী রকম সভ্যতা আর এখানকার মানুষ কতটা বঞ্চনার ভেতর দিয়ে জীবন কাটায়! তিনি প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যদের ধন্যবাদ জানান এই রকম একটি দুর্গম এলাকা নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করার জন্য। তিনি বলেন, এখানে প্রতি মাসে অথবা দুই সপ্তাহ পরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা বন্ধুসভার উদ্যোগে মেডিকেল ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় আসবেন। এমন যদি হয়, কোনো পক্ষে কোনো চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না, সেই দিন তিনি নিজেই আসবেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁর স্ত্রীও একজন চিকিৎসক, তাঁকেও নিয়ে আসবেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বোঝাতে সক্ষম হন যে মানুষের স্বাস্থ্যই সম্পদ। আর বাল্যবিবাহে এই স্বাস্থ্য কীভাবে ধ্বংস হয়।

রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ চরের বাচ্চাদের জন্য বাক্সভরে চকলেট, আলোর পাঠশালা ও স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কলম নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বাচ্চাদের মধ্যে চকলেট বিলি করেন ও শ্রেণিকক্ষে গিয়ে কলম বিতরণ করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়ের নাম আলোর পাঠশালা। নামটি শুনেই বুক ভরে যাচ্ছে। তবে আলোর নিচেই থাকে অন্ধকার। এই অন্ধকার বলতে সন্তানদের লেখাপড়া না শিখিয়ে বাল্যবিবাহ দেওয়া, মাদকাসক্ত হয়ে পড়া, চোরাচালান ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়াকেও বোঝায়। এখানে আলোর পাঠশালা সেই অন্ধকার তাড়ানোর কাজ করছে।

এলাকাটি শতভাগ বাল্যবিবাহের হওয়ার কারণে তিনি বাল্যবিবাহের আইনগত শাস্তির বিষয়টি তুলে ধরে অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এই ভালো কাজের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।

দেখা গেল, চিকিৎসাসেবা নিয়ে রাস্তায় যেতে যেতে ৮০ বছর বয়সী জানেরা ও ৭৫ বছর বয়সী লায়েকা বেগম গল্প করছেন, এত বছর বয়স হলো এই গায়ে কোনো ডাক্তার এসে চিকিৎসা দেননি। কষ্ট করে রাজশাহী শহরে যেতে হয়। যাক, এবার একটা উপায় হলো।