স্বার্থকতা যার আকাশের মতো

রণদাপ্রসাদ_সাহা
রণদাপ্রসাদ_সাহা


একজন সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠেন মনীষী বা মহিরুহ। সাধারণ একজন মানুষ হয়ে ওঠেন ইতিহাসের স্বার্ণালি অধ্যায়, যখন তাঁর কর্মজগৎ মানুষকে আলোড়িত করে, তাঁর পরিশ্রমী জীবন হয়ে ওঠে মহৎ উদাহরণ। এমনই একজন হলেন রণদাপ্রসাদ সাহা, যাঁর জীবনসংগ্রাম বটবৃক্ষের মতো দৃঢ় আর সফলতা আকাশের মতো ব্যাপক ও বিস্তৃত।

যিনি জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার সাভারে ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর। তাঁর বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ কুমার সাহা এবং মা কুমুদিনী সাহা। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। দরিদ্রতা ও চিকিৎসার অভাবে তাঁর মা সন্তান জন্মদানের সময় টিটেনাস নামক একধরনের ইনফেকশনজনিত রোগে মারা যান। মাত্র সাত বছরের শিশুর মনে এই বিষয় গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বড় হয়ে এমন কিছু করবেন, যেন কোনো মা এভাবে সন্তান জন্মদানের সময় চিকিৎসার অভাবে মারা না যান।

তাঁর চারপাশ ঘিরে ছিল দারিদ্র্যের অক্টোপাস। অর্থাভাবে তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে নতুন জীবনের সন্ধানে কলকাতায় যান। তৃতীয় শ্রেণির বেশি পড়তে পারেননি। অর্থাভাবে ১৬ বছর বয়সে কলকাতায় গিয়ে কুলিগিরি থেকে শুরু করে সব রকম কাজ করেন। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করতে থাকেন।

সমাজের সব শ্রেণির মানুষ বিশেষত দরিদ্র, অসহায়, বঞ্চিত ও অবহেলিত নারী সমাজের উন্নতির জন্য রণদাপ্রসাদ সাহা নিজের জীবন, ধনসম্পদ সব অকাতরে বিলিয়ে দেন। অক্লান্ত, অমানবিক পরিশ্রম করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যান। তাঁর জীবন বিচিত্রতায় ভরপুর। একসময় স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নেন। প্রথম মহাযুদ্ধেও তিনি অংশ নেন। প্রথমে আর্মি অ্যাম্বুলেন্স এবং পরে যুক্ত হন ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। শ্রম, মেধা আর বীরত্ব দিয়ে অর্জন করেন ‘সোর্ড অব অনার।’

সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাঁকে বিলেতে (বর্তমান লন্ডন) আমন্ত্রণ জানান। রেলস্টেশনে কিছুদিন চাকরি করেন। চাকরি করার পর কয়লা এবং নৌপরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে বাঙালিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের যাত্রা তাঁর মাধ্যমে। পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে ব্যবসা করে উপার্জন করেন অনেক অর্থসম্পদ।লবণ, কয়লা, জাহাজ, চামড়া, খাদ্যদ্রব্য, পাওয়ার হাউসের ব্যবসা করেন। তাঁর ব্যবসাক্ষেত্রের মাধ্যমে অনেক দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন।

একই সঙ্গে নারীশিক্ষা, দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য রণদাপ্রসাদ সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অসহায় অসংখ্য পরিবারকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। সমাজ থেকে ধর্মীয় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কারগুলো দূর করার জন্য গড়ে তোলেন সামাজিক আন্দোলন। দরিদ্র মানুষকে দান করার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন দানবীর নামে।

বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি সাহায্য করতে থাকেন। ত্রিশের দশকের দিকে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার মানুষ মরতে থাকে। নিজের অর্জিত অর্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলেন প্রায় ৩০০ লঙ্গরখানা। টানা আট মাস এই লঙ্গরখানার মাধ্যমে দেশের অসহায়, অনাহারী মানুষগুলোকে খাবার দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন দাতব্য চিকিৎসালয়।

নিজের এলাকায় নিজ অর্থে রণদাপ্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। এই হাসপাতালই বর্তমানে রূপ নিয়েছে বিশাল এক প্রতিষ্ঠানে। একই সঙ্গে এটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ।
রণদাপ্রসাদ সাহা ছিলেন নারীশিক্ষার একজন অগ্রগামী দূত। অবহেলিত নারী সমাজের জন্য গড়ে তুললেন ভারতেশ্বরী হোমস। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
টাঙ্গাইলে রণদাপ্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী মহিলা কলেজ।

নারী জাগরণ, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার জন্য রণদাপ্রসাদ সাহা কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। তাঁর সময়ে নারীরা ছিল অনেক অবহেলিত ও বঞ্চিত। তিনি সেই বঞ্চিত নারী সমাজের জাগরণ, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা এবং সমাজের অসহায় মানুষগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।

শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করা সম্ভব। এই বোধ থেকে ১৯৫৫ সালে মির্জাপুর আনন্দ নিকেতন নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর হাতে। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার তাঁর এই ভালো কাজগুলোকে সম্মানে ভূষিত করে। আইয়ুব খান রণদাপ্রসাদ সাহাকে ‘হেলালে পাকিস্তান’ নামে খেতাব দেন।
কিন্তু রণদাপ্রসাদ সাহা এই খেতাব গ্রহণ করেননি।

তাঁর বিত্ত বৈভব, ক্ষমতা ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি দেন। তাঁর সব অর্জিত অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন।
১৯৭১ সালে ৭ মে দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা ও তাঁর ২৭ বছর বয়সী ছেলে ভবানীপ্রসাদ সাহাকে পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। দীর্ঘ বছর পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করত যে তিনি ও তাঁর ছেলে ফিরে আসবেন। কিন্তু তাঁদের আর কোনো সন্ধান মেলেনি।

ই-মেইল: [email protected]