আমার বাবার কবর

২০১৭ সালের কথা।

আমি গিয়েছিলাম রাজশাহীতে আমাদের পিএন স্কুলের প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। দীর্ঘ ১০ বছর আমি সেই স্কুলে লেখাপড়া করেছি।

দীর্ঘ ছয় বছর পর রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। স্কুলজীবনের বান্ধবীদের কাছে পেয়ে মনে হচ্ছিল, সেই শৈশবে ফিরে গিয়েছি। অনুষ্ঠানে পুরোনো শিক্ষক–শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

ভালো লাগার সে অনুভূতির মধ্যে মনটা ছটফট করছিল আমার বাবার কবরটা দেখার জন্য।

অনুষ্ঠান সকাল থেকে শুরু হয়েছিল।

বিকেলের দিকে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার বাবাকে দেখার জন্য। মনে হচ্ছিল, কবরটা দেখা মানে বাবাকে দেখা...।

আমি বান্ধবীদের কাউকে না জানিয়ে ছুটে গেলাম আমার বাবার কবরস্থানে।

বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।

আমি এত অপদার্থ সন্তান যে কবরস্থানে গিয়ে আমার বাবার কবর আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দীর্ঘ ছয় বছর পর রাজশাহীর টিকাপাড়া কবরস্থানে গেলাম।

চারদিকে রাস্তাঘাট–বাড়িঘর সব বদলে গেছে। পুরো কবরস্থানে অনেক পরিবর্তন। আমার বুক ফেটে কান্না এল। আমি অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করলাম।

কবর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি একা কবরস্থানে। নিজেকে আমার খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। এখানে সবাই ঘুমিয়ে আছে। অনন্তকালের ঘুম।

পুরো কবরস্থান যেন নতুন হয়ে গেছে।

দেয়ালগুলো নতুন করে রং করা।

আমার কাছে চারদিক নতুন মনে হচ্ছিল।

এত কবরের ভিড়ে আমি কোথায় সেই কবর খুঁজে পাব? চোখের পানি আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আমি কিছু সময় পাগলের মতো কবর খুঁজতে শুরু করলাম।

আমার বাবা তাঁর কবর বাঁধাতে নিষেধ করেছিলেন। তাই কবরের চারদিকে কোনো দেয়াল ছিল না।

বেঁচে থাকা অবস্থায় বাবা বলতেন, ‘আমার বুকের ওপর কোনো একজন মুসলমান ভাইয়ের কবর হবে। সেই সওয়াব আমি পাব।’

কিছুতেই কবর খুঁজে পাওয়া গেল না। মনে হচ্ছিল, আমার বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, এত বছর পরে আমাকে দেখতে আসলা, আমার কবর খুঁজে পাচ্ছ না কেন? এই যে আমি তোমার পাশে।’

হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আমি অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করলাম। বুকভরা হাহাকার আমার চোখের পানি হয়ে ঝরতে শুরু করল।

হঠাৎ এক অপরিচিত বৃদ্ধ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, তুমি কি এই শহরে নতুন এসেছ?’

আমি বললাম,জ্বি ছয় বছর পর এসেছি।

তিনি বললেন, ‘মা, তাড়াতাড়ি এই কবরস্থান থেকে চলে যাও। আর কিছু সময় পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। নেশাখোর ছেলেদের অনেকেই আশপাশে থাকে। আর কোনো দিন কবরস্থানে একা আসবা না।’

তিনি চলে গেলেন। আমি কবর খুঁজে পেলাম না।

সব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে দোয়া করলাম। মন মানছিল না। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে সন্ধ্যা হতে শুরু করল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কবর খুঁজে পেলাম না।

চোখের পানি মুছতে মুছতে কবরস্থান থেকে চলে এলাম। আসার সময় কবরস্থানের কিছু ছবি তুললাম।

মনে হচ্ছিল, আমার বাবার ছবি তুলছি। আমার বাবা ছিল আমার মতো। ছবি তোলার পাগল...।

কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ লাল হয়ে  ফুলে গিয়েছিল। আবার বান্ধবীদের কাছে যাওয়ার সময় সানগ্লাস পরলাম। আমার চোখে পানি দেখলে তারা কষ্ট পাবে।

অনুষ্ঠান চলার সময় একজন বলল, ‘কী রে, তুই এই সন্ধ্যার সময় সানগ্লাস পরেছিস কেন? এখন তো রোদ নয়।’

আমি বললাম, অতি আনন্দে সন্ধ্যায় সানগ্লাস পরেছি। আমার কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করল...।’

স্কুল থেকে উপহার পাওয়া ক্রেস্টটা হাতে নিয়ে আবারও আমার চোখ ভিজে উঠল। বারবার মনে হলো, বাবা আমার কোনো অর্জন দেখে যেতে পারলেন না...।