চীনকে চিনি-৫

চীনকে চিনি-৫
চীনকে চিনি-৫


ছোটবেলায় চায়নিজ চলচ্চিত্র আর মিথলজির বইগুলো থেকে ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে চীন মানেই কুংফু কারাতে আর এক প্রকারের কাঠের তৈরি বাড়িঘর, যেগুলোর চালা দেখতে অনেকটা ডিঙি নৌকার মতো। এই ঘরের ধরন ধারণাটা আসলে প্রাচীন মিং এবং ছিং ডাইনেস্টি থেকে চলে এসেছে। এগুলোকে বলা হয় চায়নিজ মিং এবং ছিং ডাইনেস্টি স্থাপত্যশৈলী। অথচ আজকের আধুনিক চীন উঁচু উঁচু দালানকোঠা, মেট্রোরেল, বুলেট ট্রেন আর পুরোপুরি অটোমেশন সিস্টেমে জর্জরিত। আর আমরা আপাতত সেই আধুনিক চীনের কোনো এক আধুনিক শহরের জর্জরিত জনতা কিংবা প্রবাসী। নগদ টাকার লেনদেন এক প্রকারের ভুলে গেছে চায়নিজ জনগণ। মোবাইলের স্ক্রিনে সংখ্যার ওঠানামা দেখতে দেখতে তারা অভ্যস্ত। পকেটে টিস্যু কাগজের পাশে কাগজের নোট চরম অবহেলায় পড়ে থাকে।

কিছুদিন আগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ইউনান প্রদেশের ডালি নামক জেলাটা প্রাচীন চীনের ঐতিহ্যকে শক্ত আইন করে আটকে রেখেছে। পুরোনো ঐতিহ্যকে পালাতে দিচ্ছে না। ডালির মেয়র আধুনিকতার ধাক্কা সামলানোর জন্য ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, নতুন বাড়িঘর যা হবে, সব চীনের প্রাচীন ঐতিহ্য মাথায় রেখেই হবে। বাক্সের মতো উঁচু দালানকোঠা নিষিদ্ধ। আইনের ব্যতিক্রম হলেই বাক্স ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। নগরপিতার কথা জনগণ হরফে হরফে মেনে নিয়েছে। লাভের লাভ হিসেবে ডালি নামক অঞ্চলটা হয়ে গেছে চীনের প্রথম সারির পর্যটন নগরী। ভ্রমণ পাগলা মানুষজন চীন দেখতে এলে তাদের বাকেট লিস্টে ডালিকে (চায়নিজ উচ্চারণ ‘তালি’) অবশ্যই রাখেন। চীনের ঐতিহ্যকে ঘুরেফিরে দেখে চোখ জুড়িয়ে ঘরে ফেরেন।
কিছুদিন আগে আমাদের ফিল্ম একাডেমির পাঁচ বন্ধু মিলে ছোট একটা ডকুমেন্টারি বানানোর নাম করে ডালিতে চলে গেলাম। চার দিন ঘুরে ঘুরে আমার শৈশবের দেখা কল্পনার চীনের সঙ্গে বাস্তবের চীনের মিল অমিল দেখে ফিরলাম। মাসখানেকের বিরতির পর ‘চীনকে চিনি’ নামক আমার এই সিরিজটা নিয়ে আবার ফিরলাম ডালাভর্তি ডালির গল্প সাজিয়ে। এর মধ্যে ঘুরে এসেছি সাংহাই থেকেও। সাংহাই অতিমাত্রায় আধুনিক শহর। সেই গল্প আসবে পরে।
চীনের ইউনান অঙ্গরাজ্যটা হলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের রাজ্য। এই রাজ্যের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা এই প্রদেশে হাজার বছর ধরে নিজেদের কৃষ্টি–কালচার, ভাষা–পোশাকের স্বকীয়তা নিয়ে বাস করছে। চীন সরকার এই আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারে দেখলাম বেশ সচেতন। আর ডালি হলো ইজু, হোইজু এবং পাইজু নামক আদিবাসীদের রাজ্য, যাদের মধ্যে হোইজুরা হলো মুসলিম আদিবাসী। আমাদের দেশের মতো টারশিয়ারি যুগের পাহাড়শ্রেণি, হ্রদ ও ঝরনায় ঠাসা এই ডালি অঞ্চলটা একটা সময় ছিল পৃথিবীর তেরোতম বড় শহর। এখন ইউনানের একটা পর্যটন অঞ্চল মাত্র।
আমার চায়নিজ বন্ধুরা খাদ্যপাগল। তারা নতুন জায়গা মানেই বোঝে নতুন স্বাদের খাবার। আমিও ডালির ওয়েইশান এলাকায় তাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে চায়নিজ অখাদ্য খেতে লাগলাম আর তাল মিলিয়ে বলতে হচ্ছে ‘এমন স্বাদের খাবার আমি আমার জীবনে খাইনি।’
আচ্ছা ওয়েইশান এলাকার গল্প যেহেতু এসেছে, একটু করে বলে রাখি, একটা সময় মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চল, ইউনানের একটা বড় অংশ আর সিচুয়ান প্রদেশের কিছু অঞ্চল মিলে একটা রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের নাম নানচাও। নানচাওয়ের রাজধানী ছিল এই ওয়েইশান। সেগুলো ৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের গল্প। আমি ওদিকে যাব না। এমন তারিখ–সাল দিয়ে আমার এই পাতলা–পুতলা লেখাটাকে ভারী করে ফেলতে চাই না।
আমরা ডালির ওয়েইশান নামক এই পুরোনো রাজধানীতেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিলাম। আমার ওয়েইশান ভালো লেগে গেল। পুরো শহরটা ঘুরে দেখতে গিয়ে একটা সময় মনে হলো পুরো শহরটা একটা দাবার ছকের মতো। পায়ে হাঁটার ঝকঝকে লম্বা রাস্তা। রাস্তা পাথরের তৈরি। দুই ধারে নানান ধরনের দোকান। ফুটপাতে কিছুদূর পরপর ওয়েইশানের গল্প বহন করা পাথরের ভাস্কর্য। শহরের চারপাশে বড় বড় রাজকীয় ফটক। শহর ঘুরতে ঘুরতে আপনার মনে হতে পারে যেন এখনো সেই পুরোনো রাজত্ব চলছে। ভোর সকালের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে পঞ্চাশোর্ধ্ব কোনো এক বৃদ্ধা রাস্তার ধারে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা বিক্রি করছে। একদল গোল করে বসে রাস্তায় রোদ পোহাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে বাচ্চারা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিয়েছে আর রাতে শহর পাহারা দেওয়া কুকুরগুলো দলা পাকিয়ে কোনো এক কোণে ঘুমাচ্ছে।
রাতের শহর সোডিয়াম আলোয় ভরপুর। এই আলোর ব্যবস্থা করেছে সরকার। বাড়িঘরগুলোর কাঠামো ঠিক রেখে চালার ধার ঘেঁষে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে লালচে হলুদ বাতি।
শেষ দিন সময় করে শহর ছেড়ে চলে গেলাম ওয়েইশানের এক পাহাড়ে। আচ্ছা, এই এলাকার নাম ওয়েইশানে ‘ওয়েই’ অর্থ কী সেটা আমি ভুলে গেছি কিন্তু ‘শান’ মানে হলো পাহাড়। শুনেছি সেই পাহাড়ের চূড়ায় একটা বসতি থাকে, যেটা রাজতন্ত্রের সময় এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনীদের বসতি ছিল। গোয়াল ভরা ছিল গরু এবং ভেড়া। এখনো আছে। একসময় এই ভেড়া–ছাগল তাদের এই অঞ্চলের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় তুলে আনতে পারলেও এখন আর পারছে না।