যেন এক জাদুর দুনিয়া


আহ! কী আনন্দ বাতাসের সাথে মিশে আছে। কী আনন্দ মৌচাকের মাঠের ঘাসে। এত আনন্দের জলধারা আর বহে কোথায় বলো? এ যে শুধু বন্ধুত্বের জয়গান, জয়তু বন্ধুসভা।
পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ছোট্ট দেশের নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বুকে সবচেয়ে বড় পরিবারের নাম বন্ধুসভা, যে পরিবারের স্বপ্ন একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার। বন্ধুসভার স্বপ্নদ্রষ্টা দন্ত্যস রওশনের লেখা ‘সুন্দর একটি বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই’—বন্ধুসভার গানের এই পঙ্‌ক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর সেই স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার রক্ষা করতে সারা দেশের বন্ধুরা দল বেঁধে নেমেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে। বন্যার্ত মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে খাবার। হাজার হাজার বৃক্ষ রোপণ করে সবুজ করে তুলছে আমাদের পৃথিবী। ঈদের খুশি ছড়িয়ে দিতে নিজের জন্য জামা কেনার টাকায় জামা কিনে দিচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের। কত উদ্যম, কত তারুণ্য, কত উচ্ছ্বাস, কত উন্মেষ আর কতটা সুন্দর মনের মানুষ আমাদের বন্ধুরা!

৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে মৌচাকের স্কাউট মাঠে বসেছিল এই সুন্দর মনের বন্ধুদের মিলনমেলা। সারা দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরা জমায়েত হয় এ মাঠে। সরিষাবাড়ী বন্ধুসভার ১৫ জন বন্ধু যোগ দেয় এই মিলনমেলায়। ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় স্কাউট মাঠে পৌঁছে দেখি অনেকগুলো বন্ধুসভার বন্ধুরা চলে এসেছে। কনফারেন্স রুমে বৈঠক চলছে। বক্তব্য রাখছেন দন্ত্যস রওশন। পাশে মুমিত আল রশিদ, শাকিল মাহবুব, আশফাকুজ্জামান, শাহিন মাহফুজ, ফিরোজ আলমসহ আরও বন্ধুরা। সমাবেশের দিন দুটিকে চমৎকার করার নানা কৌশল শিখছেন উপস্থিত বন্ধুরা।
৭ ফেব্রুয়ারি ভোর হতে না–হতেই তাঁবুতে তাঁবুতে চলে বন্ধুদের খোঁজখবর নেওয়ার অভিযান। মোংলা থেকে পার্বতীপুর দুই সেকেন্ডের পথ। পঞ্চগড় যেতে লাগল দেড় মিনিট। সিলেট, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বাংলাদেশ ঘুরে দেখা হয়ে গেল মাত্র ৩০ মিনিটে। কথা হলো প্রতিটি অঞ্চলের বন্ধুদের সঙ্গে। এ যেন এক জাদুর দুনিয়া!


সকাল নয়টার মধ্যে নাশতা শেষ করে বন্ধুরা একে একে জড়ো হতে থাকে মাঠের পূর্ব প্রান্তে। সারাদেশের বন্ধুদের তৈরি দেয়ালিকায় বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে স্কাউট মাঠের প্রবেশপথ। মহানগর বন্ধুসভার বন্ধুদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীত আর আমাদের সবার প্রিয় দন্ত্যস রওশন ভাইকে ঘিরে উল্লাসিত বন্ধুদের সমবতে কণ্ঠে ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! বাংলাদেশ’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জাতীয় সমাবেশ ২০২০।
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে চলে মহানগর সভার বন্ধুদের নৃত্য। বন্ধুসভার থিম সংগীতের সঙ্গে বন্ধুদের মেলানো সুরে মনে হচ্ছিল মৌচাককে ঘিরে মৌমাছির গুনগুনানি মধুরধ্বনি। পরে মঞ্চে এলেন সাদা চুলের গুড্ডুবুড়া—আমাদের আরেক প্রিয় অভিভাবক আনিসুল হক। শোনালেন তাঁর লেখা ‘মা’ বইয়ের গল্প। শহীদ আজাদের মা আজাদকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দেন। কারাগারে আজাদকে একমুঠো ভাত খাওয়াতে না পেরে বাকি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন ভাত না খেয়ে কাটিয়েছিলেন।

সন্ধ্যা বয়ে গেলে আবারও মঞ্চে এলেন আমাদের নেতা। আমাদের নেতা মানে যার বিরতিহীন বক্তব্যে বন্ধুদের তিক্ততা আসে না। আমাদের নেতা মানে হৃদয় নিংড়ানো হাসির ঝুলি, যে হাসি শেষ হতে চায় না। আমাদের নেতা মানে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা দন্ত্যস রওশন। চলল কয়েক মিনিটের পিনপতন নীরবতা। এই পর্বে আমাদের নেতা দন্ত্যস রওশন বলছেন, আমরা শুনছি। আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমাদের মা, আমাদের চোখ জলে ছলছল হয়ে উঠছে। আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ রক্তাক্ত। এই বাংলাদেশ নির্যাতিত। এই বাংলাদেশ বিভীষিকায় পরিপূর্ণ। আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে ফিরে গেছি। আমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারছি, কতটা ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ পেয়েছি। আমার মতে এবার সমাবেশে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল এই পর্বটা।

সমাবেশের দ্বিতীয় দিন। ভোর হতে না–হতেই তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরে বন্ধুদের ঘুম ভেঙে দেওয়ার আনন্দে পরিপূর্ণতা লাভ করে আঞ্চলিক বাংলা ভাষা। কারণ, সকালের ঘুম ভাঙার পর সবার আচরণ হয় প্রাকৃতিক। মুখের কথায় চলে আসে নিজ নিজ অঞ্চলের টান। সকালের নাশতা শেষ করে আবারও বন্ধুরা সামিয়ানার নিচে সমবেত হতে থাকে। মঞ্চ আলোকিত করে বন্ধুদের জন্য ভারী ভারী কথার ঝুড়ি খুলে বসেন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন। অভিনেত্রী জয়া আহসান শোনান তাঁর স্বপ্নজয়ের গল্প। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। আসলে আনন্দের সময় বুঝি এমনি করে দ্রুত শেষ হয়ে যায়। পঞ্চম জাতীয় সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা মনটাকে ভারী করে দিল।
উৎসবের এই দুই দিনে যে প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়েছে, সে বন্ধন উৎসব শেষে বাড়ি ফেরার সময়টাকে করে তুলেছিল অশ্রুতে ভরপুর। আসি বন্ধুরা, বিদায়! বারবার বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি করা। আবার দেখা হবে—এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া। যেন আপনজন ছেড়ে বিদেশ চলে যাচ্ছেন বন্ধুরা। নির্মল ভালবাসা, অফুরন্ত উদ্দীপনা, নিজের জন্য, মানুষের জন্য, দেশের জন্য কিছু একটা করার মন্ত্র শিখে আর জ্ঞানের আলোয় স্নান করে বাসায় ফিরেছে প্রতিটি বন্ধু।
সভাপতি, সরিষাবাড়ী বন্ধুসভা