মানুষের জন্য মানুষ

২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে হয়েছিল ভয়াবহ সিডর। সেই সময়ে গলাচিপা বন্ধুসভার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন বন্ধু আশফাকুজ্জামান। ত্রান বিতরণের স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি।
এ এক অদ্ভুত দ্বীপ! সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা ছোট্ট এক মায়াবী জনপদ। খালি চোখে না দেখলে বোঝা যায় না কত সুন্দর! চারদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশি। মাথার ওপর দিগন্তজোড়া নীলাকাশ। এরই মধ্যে এক খণ্ড ভূখণ্ড। পুরাটাই দূর্বাঘাসের চাদরে মোড়া। এ যেন এক সমুদ্রকন্যা অপার সৌন্দর্যে সেজে আছে। দূরে যত দূর চোখ যায় কোনো ঘরবাড়ি জনমানুষ নেই। এদের প্রতিবেশী বলতে সাগরের মাছ, সাগরের জলরাশি, মাথার ওপরে মেঘের ভেলা, চরের এক পাশে আপন মনে বেড়ে ওঠা গাছ। একমাত্র মাছ ধরাই জীবিকা। সপ্তাহে একবার গঞ্জে যায় কেনাকাটা করতে।

আগের দিন সন্ধ্যায় খবর পেলাম। দুর্গম এক দ্বীপে অসহায় মানুষ আছে। তাদের দ্রুত সাহায্য দরকার। রাত শেষে ভোর এল। ভোরে রওনা হলাম সেই দ্বীপে।
এ দ্বীপবাসীর জীবনে ছোট–বড় অনেক স্বপ্ন জমা ছিল। সব ভেসে গেছে সিডর নামক ভয়ংকর এক জলোচ্ছ্বাসে। গ্রাস করেছে নারী–শিশুকে। যারা বেঁচে আছে, তাদের জীবনেও প্রতি মুহূর্তে ভয়, অনিশ্চয়তা। বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকার শঙ্কাই বেশি। দূর থেকে ছুটে আসছেন আমাদের দেখে। কেউ কেউ খানিকটা পানিতেও নেমেছেন। ভয় লাগছে। টানাটানি করলে ট্রলার ডুবে যেতে পারে।
উপায় না দেখে বললাম, ভাই, আমরা পত্রিকা থেকে এসেছি। আপনাদের কষ্টের কথা লিখব। তখন সাহায্য আসবে। একেবারে তো খালি হাতে আসা যায় না। কিছুটা খাবার এনেছি। আপনারা যদি কষ্ট করে লাইন দেন, তাহলে দিতে পারব। তা না হলে হয়তো ফিরে যেতে হবে। তখন সবাই লাইন দিল। যাকে যতটুকু পারি সেভাবে দিলাম।

অনেকের মধ্যে একজন ছিল অন্য রকম। সে ছুটছে উদ্ভ্রান্তের মতো। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। বুঝতে পারছি না। তার নাম নন্দলাল কর। করের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ছিল তাঁর স্ত্রী রসমালাই ও নাতনি চাঁদনি। অন্যদের মতো এই পরিবারটিও পড়েছিল জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে। নন্দলাল জীবনের সবটুকু শক্তি নিয়ে চেষ্টা করেছিলেন স্ত্রী আর নাতনিকে ধরে রাখার।
কিন্তু তিনি হেরে গেছেন প্রবল ঢেউ ও রাক্ষসী স্রোতের কাছে। নাতনি চিৎকার করে বলেছিল, দাদু ছাইড়ো না ছাইড়ো না। স্ত্রী বলেছিল, ‘মোরে শক্ত কইরে ধইরো। ছাইড়ো না। দোহাই তোমার মোরে ছাইড়ো না।’ কখন যে নাতনি ছুটে গেছে, কিছুই জানে না নন্দ। রসমালাইকেও তিনি ধরে রাখতে পারেননি। এরপর থেকে জগতের কোনো কিছু তাঁকে আর স্পর্শ করে না। তাঁর এই নিরন্তর ছোটাছুটি হয়তো স্ত্রী–নাতনির কাছে চলে যাওয়ার জন্য।
মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন। এই যে এত নৈসর্গিক দৃশ্যে পূর্ণ একটি জায়গা। এর সৌন্দর্য এরা কতটা অনুভব করে? এরা কি আনন্দে বৃষ্টিতে ভেজে? পূর্ণিমা রাতে জোছনা দেখে? প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্রের এই বেলাভূমিতে বেড়ায়? নাকি এই নান্দনিকতা উপভোগ করার মতো জীবনবোধই তাদের নেই? রবীন্দ্রনাথের কোনো এক গল্পে পড়েছিলাম, ‘যে পোকা আমের মধ্যে জন্মে, আমের প্রতি তার আগ্রহ থাকে না।’ এরাও তেমনি সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমিতে থেকেও হয়তো সে সৌন্দর্য অনুভব করতে পারে না। তবে এটা ঠিক যে ত্রাণের জন্য মরিয়া হয়ে ছুটছে। কারণ, মানুষকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হয়।

সময় কাটছিল ভীষণ একটা ঘোরের মধ্যে। এখানে নেটওয়ার্ক থাকে, থাকে না। এর মধ্যেও ফোন বেজে উঠল। আশফাক কোথায়? সমুদ্রের মধ্যে এক চরে। চরের নাম শোনার পর রওশন ভাই আঁতকে উঠলেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে রওনা হতে বললেন। মনে হলো একটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আছি। দ্রুত চলে যাওয়া দরকার। কিন্তু যেতে ইচ্ছা করছে না। বারবার শুধু সবাইকে নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। মানুষের সব ইচ্ছা কি আর পূরণ হয়? 
বিত্তবানদের কত বৈচিত্র্য! কিন্তু জগতে দুর্ভাগা মানুষের ভাগ্য এক। কী রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি। ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া মৃত আয়লানদের মুখ। অথবা ভয়াবহ সিডরে সব হারানো মানুষের দীর্ঘশ্বাস। সব যেন একসূত্রে গাঁথা। খানিকটা কষ্ট জমা হলো মনে। আসলে প্রকৃতি চলে তার নিয়মে।
টলার চলছে। খানিকটা রাত নেমে এসেছে।একটু ভয়ও লাগছে না। রওশন ভাই ফোন না দিলে কখন রওনা হতাম জানি না। আশ্চর্য, চার–পাঁচজন মানুষ একসঙ্গে ছিলাম, কারও মধ্যেই ফিরে আসার তাড়া ছিল না। বুঝতে পারছি না কখন পৌঁছাব। চলতে চলতে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। মাঝি বলল, ‘ভাই, কাম হারছে, মোগো নাও থাইমা গেছে।’ সবাই সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। কী হবে জানি না। ইঞ্জিন থামার পর চারদিকের এক ভয়ানক নৈঃশব্দ্যতা অনুভব করলাম। কেউ কথা বলছে না। কোনো কোনো সময় নীরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়। ভীষণ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলাম।
প্রথম দিকে ঘটনা ছিল স্বাভাবিক। এখন সূর্য ডুবে গেছে। রাত নেমে এসেছে। সবাই আতঙ্কিত। কেবল মাঝিকে বুঝতে পারছি না। সে আছে তার মতো। ভাবখানা এমন যে বড় কোনো দার্শনিক। কোস্টগার্ডকে একটানা ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। তানিম বলল, ‘ভাইয়া কী হবে? আমরা কি আর বাঁচব না? কারও তো মৃত্যুর বয়স হয়নি। কপালে যা লেখা আছে, তাই হবে।
সুজন বলল, ভাইয়া মাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। আগে যে দেখেছ সে স্মৃতি মনে করো। না ভাইয়া আপনারা আমার ব্যাপারটা বুঝবেন না। তা ঠিক বিপদের সময় আমরা অনেক কিছু বুঝি না।
আনিস বলল, ভাইয়া আমারা কি টাইটানিকের মতো ডুবে যাব? না। চারদিক জনমানবশূন্য। যেদিকে তাকাই, শুধু পানি আর পানি। নৌকা আটকে গেছে ডুবোচরে।

যেকোনো সময় প্রায় সবার মোবাইলের চার্জও শেষ হয়ে যাবে। কারও সঙ্গে যোগাযোগের উপায় থাকবে না। ভাবছি, খাবারে কয় দিন চলবে। এদিকে গভীর হচ্ছে রাত। আমিন ও শোয়েব কান্না জুড়ে দিল।

নিশ্চিত মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যুর আগে মানুষের অনুভূতি কী হয়, সেটি বুঝতে চেষ্টা করছি।
মৃত্যুর জন্য বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ালে একজন মানুষ হয়তো শেষবার তার প্রিয়জনদের দেখতে চায়। নাকি সক্রেটিসের মতো বলে, ‘আমি মরে যাই, তোমরা বেঁচে থাকো। ঈশ্বরই ভালো জানেন দুটির মধ্যে কোনটা ভালো।’
আমাদের কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না। আত্মহত্যার আগে মানুষ চিরকুট লিখে। উদ্দেশ্য প্রিয়জনদের অল্প কথায় মৃত্যুর কারণ জানানো। আমাদের যদি মৃত্যু হয়, সেটা আত্মহত্যা হবে না। এটা হবে ডুবোচরে আটকে থাকা নৌকার পাটাতনে মৃত্যু। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কিছু লিখব কি না। আবার লিখলে যে কেউ পাবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। পৃথিবীতে এমন মৃত্যুর উদাহরণ আছে কি না, মনে করার চেষ্টা করছি।
এমন সব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ দেখি নৌকা নড়ে উঠেছে! তখনো বুঝতে পারছি না কী ঘটতে যাচ্ছে। ‘মোগো কফাল খুলছে’ বলে মাঝি একটা চিৎকার দিল। বলল, ‘গাঙ্গে বান আইছে, নাও বাওন যাইব। আর কোনো চিন্তা নাই।’
সুজন জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। মনে পড়ল, সুজন তার মাকে দেখতে চেয়েছিল। এবার আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। ইঞ্জিনের ভটভট উচ্চ শব্দে ঘুম ভাঙল নির্জন সাগরকন্যার। উপকূলে ফিরে এলাম ভোর পাঁচটার দিকে।
সব খুলে বললাম রওশন ভাইকে। তিনি এমন একটা পুরস্কার দিতে চাইলেন, যা পৃথিবীর মানুষ দিতে পারে না। প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা মানুষের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরা নিজেদের কথা ভাবেন না। সিডর কেন, যেকোনো দুর্যোগে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান।

সাংবাদিক ও সংগঠক