যারা দিনে আনে দিনে খায়


খবরটা শোনার পর থেকেই কেমন যেন অস্থির লাগছে। অস্থির ঠিক নয়,শরীরটা খারাপই লাগছে। শরীর খারাপ লাগছে কিন্তু সে কথা কাউকে বলতে পারছি না। অথচ সামান্য একটু হাঁচির খবরও জানত পরিবারের সবাই। দিনে তিনবার হাঁচি দিলেও সে খবরটা মা–বাবা থেকে শুরু করে এমন কেউ নেই, জানত না। আর সেই তিনবারের হাঁচির খবর নিতে অন্তত নয়বার করে ফোন দিত প্রত্যেকেই।

অথচ আজ আমার খারাপ লাগার কথা, অসুস্থতার কথা কাউকেই বলছি না আমি। এমনকি কাউকে বুঝতেও দিচ্ছি না। কিছুক্ষণ আগেও নিজেকে অসুস্থ বলে মনে হয়নি আমার। তবে খবরটা শোনার পর থেকেই সমস্যাটা অনুভব করছি। কাল থেকে সারা শহর লকডাউন। আমি যেখানে থাকি, ঠিক তার পাশের বাড়িতে পাওয়া গেছে করোনা আক্রান্ত রোগী।
আমেরিকাফেরত দুজন বাংলাদেশি।
আমি গতকাল যে বাজারে কাঁচাবাজার করেছি, ওরাও কাল ঠিক সে বাজারেই বাজার করেছে। শুধু তা–ই নয়, এখানে এই সংকটকালেও গতকাল উপনির্বাচন হয়েছে। যখন শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও বন্ধ করা হয়েছে, তখন কেন উপনির্বাচন বন্ধ করা হলো না, এ নিয়ে মনের মধ্যে অনেক ক্ষোভ থাকলেও অনেকেই ভোট দিতে গিয়েছেন। কেউ কেউ যেতে বাধ্য হয়েছেন। আমি ঠিক বাধ্য না হলেও গিয়েছি। প্রার্থীর খুব কাছের একজন আমাকে অনুরোধ করেছে। বলতে গেলে হাতে–পায়ে ধরেছে। সংকট সেখানে নয়, শুনতে পাচ্ছি ওই দুই আমেরিকাপ্রবাসীও গিয়েছিল ভোট দিতে। খবরটা শুনতেই বুকের ভেতরের ব্যথাটা আরও যেন বেড়ে গেল। বিষয়টা কারও সঙ্গে শেয়ার করব, তারও উপায় নেই। তাহলে মুহূর্তেই অন্য রকম ভাবনা শুরু হবে, কান্নাকাটির রোল পড়বে। তার চেয়ে বরং বেরিয়ে পড়ি।একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কী কী করণীয়, তা একবার ভেবে নিলাম। তারপর কাউকে কিছু না বলেই বেড়িয়ে পড়লাম।
শহরের রাস্তায় পা ফেলতেই পৌরসভার মাইকিং কানে এল। করোনার লক্ষণ ও সচেতনতা জানিয়ে মাইকিং করছে তারা। লক্ষণগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। না, এই মুহূর্তে বুকব্যথা ছাড়া কোনো লক্ষণই মিলছে না। নিজে নিজে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালাম। আরে, বুকব্যাথা তো নানা কারণেই হতে পারে। তবে নিজের ব্যাখ্যার কাছে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। না, দেখা করে নয়। আগে ফোনে বিষয়টা জানাই। আমার পরিচিত এক ডাক্তার ফোনে সব শুনে আশ্বস্ত করলেন, ভয়ের কিছু নেই। তবে সতর্কতা হিসেবে যা বললেন, সে অনুযায়ী আরও কয়েকটা স্যানিটাইজার ও মাস্ক কিনে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম। মনে মনে স্থির করলাম, শহর লকডাউন হোক আর না হোক, আমি গৃহে লক হব। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আরও আগেই তা হওয়া উচিৎ ছিল। সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করা ঠিক হয়নি আমার। নিজের ভেতরেই অনুশোচনা তৈরি হলো একরকমের। আমার হাঁটার গতি যেন আরও বেড়ে যায়। এতক্ষণ লক্ষ করিনি, শহরের পুরো রাস্তা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। যে কয়েকজন মানুষ আছে, তারাও যেন তটস্থ। চলছে হন্তদন্ত হয়ে। ব্রিজের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে একজন রিকশাচালক। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। আমার গ্রামের বাড়ির এলাকার রহিম চাচা। আমাকে দেখেই রিকশার প্যাডেলে পা রাখলেন, আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই হয়তো রিকশার বেলটা বাজালেন। বাবা সৈকত, বাসায় যাবা, ওঠো। আমি নিয়ে যাই। কথাটা বলেই একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি উঠব কি উঠব না ভাবার সুযোগই দিলেন না। একরকম নিরুপায় হয়েই উঠলাম। রিকশায় উঠেই মনে হলো আমার রিকশায় ওঠা ঠিক হলো না। যদি আমার কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে তো এই রিকশায় যে-ই উঠবে, তারই সমস্যা হবে। পরক্ষণেই ডাক্তারের কথা মনে হলো।
ডাক্তার তো বললেন, ভয়ের কিছু নেই। তারপরও আমার ওঠা ঠিক হয়নি। এমন ভাবনায় আমি যখন আচ্ছন্ন, ঠিক তখনই আচমকা রহিম চাচার প্রশ্ন, বাবা সৈকত? লকডাউন কী? আমি উত্তর দিই। লকডাউন হলো সবকিছু বন্ধ করা। মানুষ ঘরের ভেতর থেকে বের হতে না পারা। কথাটা শুনতেই রিকশার প্যাডেলে রাখা রহিম চাচার পা দুটো যেন থেমে গেল। কী কও, বাবা? ঘরের বাইরে না বের হলে খাব কী? রিকশা না চললে তো অনাহারে মরব। তার ওপর কিস্তির টাকা। আমি জানতে চাইলাম, কিসের কিস্তি? রহিম চাচা জানালেন, তার রিকশাটা একটা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কেনা। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় তাকে। কিস্তির লোক বিকেল থেকে বসে থাকে। টাকা না নিয়ে ফিরে যায় না। আমি এর উত্তরে কী বলব, ভেবে না পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাই। লকডাউন না হলেই তো বিপদ চাচা। বাইরে বের হলেই তো প্রাণঘাতী ভাইরাস। কথাটা শুনতেই রহিম চাচার নিরুত্তাপ উত্তর। বুঝছি, মরণের বিকল্প নাই। বাইরে বের হলে ভাইরাস, ঘরের ভেতর অনাহার। আমি রহিম চাচার এই কথায় কী বলব, ভেবে পেলাম না। শুধু বললাম, নিশ্চয় সরকারের কোনো পরিকল্পনা থাকবে। নিশ্চয় আপনাদের জন্য কোনো একটা ব্যবস্থা থাকবে। আমার এ কথা শুনে রহিম চাচা আমার দিকে ফিরে চাইলেন। তার চোখমুখে কেমন একটা আনন্দের ছাপ ফুটে ওঠে। আমি অবাক হয়ে তার সেই মুখটা দেখি। এই মানুষগুলো কত অল্পেই সন্তুষ্ট। অথচ আমরা...। ভাবনাগুলো আর এগোতে পারলাম না।
বাসায় ফিরলাম। কাউকে কিছু না বলেই টিভিরুমে বসে পড়লাম। দরজাটাও ভিড়িয়ে দিলাম। টিভি ছাড়তেই দেখি আপাতত আমার জেলায় লকডাউন হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম, যে দুজন আমেরিকাপ্রবাসী করোনা আক্রান্ত, তারা আমার এলাকার নন। তাদের সঙ্গে কাঁচাবাজার কিংবা অন্য কোথাও দেখা হয়নি আমার। বিষয়টা নিশ্চিত হতেই আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটল। আমার বুকের ব্যথাটা একবারেই যেন থেমে গেল। আমি নানাভাবেই পরীক্ষা করলাম। না, আমার বুকের কোথাও কোনো ব্যথা নেই।

সাবেক সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা।
রাজশাহী