চীন থেকে বলছি: দেশের সকলে ভালো থাকুক

সপরিবারে লেখক মো. সানোয়ার হোসেন
সপরিবারে লেখক মো. সানোয়ার হোসেন


চীনে যখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কয়েকজন হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে ধরা পরে তারপর থেকেই আমরা জানতে পারি এবং আমাদের শহরের মানুষের মধ্যেও একধরনের সতর্কতা চোখে পরে এটা জানুয়ারির ২২ তারিখের কথা। একদিন পরেই ২৪ তারিখে চাইনিজদের সবচেয়ে বড় উৎসব চাইনিজ নববর্ষ এবং স্প্রিং ফেস্টিবল কাজেই পুরো চায়নাতে সাজ সাজ রব।

প্রতিবছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বুফে ডিনার এবং উপহার সামগ্রী থাকে। কিন্তু এ বছর করোনা ভাইরাসের কারনে সতর্কতা হিসাবে বুফে ডিনার না দিয়ে প্যাকেটে খাবার দিয়েছে এবং সবাই নিজ নিজ রুমে বসে খেয়েছে । যাতে বড় জমায়েত সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায়। যদিও উহান থেকে আমাদের হাংজু শহরের দুরত্ব প্রায় ৬০০ কিলোমিটার তখনও আমাদের শহরে এমনকি আমাদের জেজিয়াং প্রদেশেও কোন আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়নি। তখন সারা চায়না জুড়ে নববর্ষের ছুটি থাকায় প্রায় সব অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমও বন্ধ ছিলো। বছরের শুধুমাত্র এই একটি সময়েই চাইনিজরা তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটায় একসাথে ডিনার করে, ঘুরে বেড়ায়। আস্তে আস্তে উহানে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং আমাদের কাছেও বিভিন্নভাবে নির্দেশনা আসে খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাহিরে না যাওয়ার। সে সময় (জানুয়ারির শেষ দিকে) বিদেশীদের মধ্য থেকে অনেকেই যার যার দেশে চলে যেতে শুরু করে। তখন আমরা বাংলাদেশী বেশ কয়েকজন চীনে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করি কিন্তু সে সময় বাংলাদেশে থাকা বাবা-মাসহ পরিবারেরর অন্য সদস্যদের বুঝাতে বেশ কষ্ট হয়েছে যে আমরা নিরাপদে এবং সাবধানে আছি।
অনেককেই দেশে চলে যেতে দেখে মনটাতে কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করতাম। যেহেতু আমি আমার স্ত্রী এবং মেয়েসহ চীনে অবস্থান করি কাজেই অনেকের মধ্যেই দুশ্চিন্তাটা ছিল অনেক বেশী। ফেব্রুয়ারী মাসের ৩ তারিখে আমাদের শহর থেকে সর্বশেষ বিমান বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যায় কাজেই তারপর থেকেই পরিবারের সবার সাথে কথা বলে তাদেরকে বুঝাতেই দিনের কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে।

দেশে-বিদেশে থাকা বন্ধুরাসহ অনেক শুভাকাঙ্খী এবং আত্মীয়স্বজনও খোজ খবর নিয়েছে। তখন আসলে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি জীবনেরর স্বার্থকতা। তখন আমি সব সময় ভাবতাম আমি যদি কোন কারনে দেশে গিয়ে আক্রান্ত হই তাহলে সবার আগে আমার পরিবারের লোকজন আক্রান্ত হবেন। আস্তে আস্তে আমার আশে পাশের লোকজন থেকে পুরো দেশটা আক্রান্ত হবে। কাজেই মনে প্রাণে চাইতাম আমার দেশটা এবং আমার পরিবার ভাল থাকুক।

এসময়ে আমরা বাংলাদেশী যারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম অনেকের সাথেই আমাদের নিয়মিত কথা হতো একে অপরের খোজ খবর নিতাম। রুমে থেকে সবার সাথে কথা বলাটাই আমাদের অক্সিজেনের মত কাজ করেছে।

ফেব্রুয়ারির ৪-৫ তারিখ থেকে আমাদের চলাচলের উপর কিছুটা বিধি নিষেধ আসতে শুরু করলো ততদিনে আমাদের প্রদেশে এবং শহরেও দুই একজন করে আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তখন থেকেই ক্যাম্পাসের বাইরেযাওয়াতে কিছুটা সীমাবদ্ধতা দেওয়া হল, ক্যাম্পাসে ঢুকার সময় শরীরের তাপমাত্রা মাপা হতো, বাহিরে কিছু কিনতে যেতে হলে একমাত্র সুপারশপ ওয়ালমার্ট যেতে পারতাম সেটাতে ঢুকতেও তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হতো। কোন কারণে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী ধারা পরলেই হাসপাতালে জোর করে নিয়ে যাবে। তখন খুব আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটছে, এভাবে কয়েকদিন বাহিরে গিয়ে প্রয়োজনীয় খাবার কিনে জমিয়ে রাখি যেটাতে এখনও চলছে।
তখন থেকে শুরু হলো আমাদের নিয়মিত শারীরিক অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে জানানো। আমার মেয়ের স্কুল থেকে তার শিক্ষকেরা রোজ সকাল নয়টার মধ্যে তার শারীরিক অবস্থাসহ আমরা কেমন আছি জানতে চাইতেন যদিও স্কুল বন্ধ। আমরা সম্প্রতি উহানে ভ্রমণ করেছি কি না? ইত্যাদিসহ বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়মিত দিতে হতো। এখন পর্যন্ত প্রতিদিন আমরা আমাদের শারীরিক অবস্থার খবর অনলাইনে জানাই। আমাদেরকে আমাদের করনীয় বিষয়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেতাম। জরুরি প্রয়োজনে কখন কি করতে হবে ইত্যাদি। ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে আমাদেরকে পুরোপুরি লক ডাউন করে দেয় যদিও এর আগেই শহরের পাবলিক পরিবহন এবং ট্যাক্সিও বন্ধ করে দিয়েছে। ঘর থেকে একদম বের হওয়া নিষেধ করে দিল। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তাদেরকেও পুরোপুরি বের হতে নিষেধ করে দিলেন। তারপর অনলাইনে প্রত্যককে হেলথ কোড করতে হলো, বাইরে যেতে হলে তারা হেলথ কোড দেখিয়ে সপ্তাহে একদিন প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য বাইরে যেতে পারতেন। যদি হেলথ কোড সবুজ থাকে। হেলথ কোড এর রং নির্ভর করবে আপনার সম্প্রতি ভ্রমণ রেকর্ড এবং তাপমাত্রার উপর। তবে আমরা যারা ক্যাম্পাসের মধ্যে আছি তারা এখনও বাইরে যাওয়ার কোন অনুমতি পাইনি। মাঝে আমাদের সবজি এবং মাংস ফুরিয়ে যাওয়ায় ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানকারী ভাইদের সহায়তায় খাবারে তেমন কোন সমস্যা হয়নি।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো চীনে অবস্থানকারী প্রত্যেককে প্রতিদিন তাদের শারিরিক অবস্থা জানাতে হয়। আমরা যেখানে থাকি সেখানে প্রতিদিন সকাল ৯ টার দিকে পুরো বিল্ডিং ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ওয়াশ করে এমনকি রুমের দরজা এবং লিফ্টেও স্প্রে করে।
সর্বোপরি চাইনিজ প্রশাসনের অত্যান্ত সতর্কতার কারনে আমরা এখনও সুস্থ আছি।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন, মনেপ্রাণে চাই বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ সুস্থ থাকুক, নিরাপদে থাকুক। তবে এ জন্য চাই প্রতিটা মানুষের সচেতনতা।

সহকারী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
এবং পিএইচডি গবেষক, জেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়, হাংজু, চীন।