এ মন আমার


স্টকহোম এ সময় বরফে ডুবে থাকে। এমনিতে ঠান্ডার দেশ, এখন যেন বাতাসে তরল নাইট্রোজেন ভাসছে। মানুষগুলোও এই শীতল আবহাওয়ার মতো—রুক্ষ, নিষ্প্রাণ। এ দেশের লোকদের মনে হয় যন্ত্র, রোবট যেন একেকটা। মন নেই, হৃদয় নেই। তাই বুঝি মন ভাঙার কষ্টটাও নেই। ধীরে ধীরে আমিও যান্ত্রিক সুইডিশ হওয়ার চেষ্টা করছি।
ফোনটা বেজেই চলেছে। ইমোতে মা কল করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শীতে এখানে সবার মেজাজ বিগড়ে থাকে। আমার অবশ্য ‘মন’টা উড়ুউড়ু করছে। ধ্যাত, গেঁয়ো ‘মন’ জিনিসটা থেকে বের হতে পারছি না। আজকের পর অনেকটাই পারব মনে হচ্ছে। এ দেশে এসেছি ছয় মাস হয়ে গেছে। এই এক শ আশিটা দিনে আমি অনেক আধুনিক হয়ে উঠেছি। আমি এখন যখন–তখন হাসি না, দেশে ফোন দিই না, দেশ থেকে মা-বাবা ফোন করলে একবারে ধরি না। হাত দিয়ে খেতে এখন ঘেন্না লাগে আমার। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে অবাঙালি বাড়ছে। দেশের কারও পোস্টে লাইক, কমেন্টও করি না আজকাল। অনেককে তো আনফ্রেন্ডই করে দিয়েছি। দেশে থাকতে আমাকেও খুব কাছের একজন প্রথমে আনফ্রেন্ড, পরে ব্লক করে দিয়েছিল। মনটা ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে গিয়েছিল। আমার এখন অভিযোজন চলছে। প্রক্রিয়াটা শেষ হলেই বেঁচে যাই। তখন আমার কোনো মন থাকবে না। আর কেউ মন ভাঙতে পারবে না আমার।

রুম হিটার চলছে পুরোদমে। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস ১৮, ভেতরে প্লাস ১৮। আমি একটার পর একটা পুশ-আপ করে যাচ্ছি আর ঘামছি দরদর করে। ৯৮, ৯৯, ১০০। চিকন মেয়েলি কণ্ঠে গান ভেসে আসছে। ক্যারিবিয়ান সুর। অনেকটা কুমার বিশ্বজিতের ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে’র মতো লাগছে। জেনিফার মেক্সিকোর মেয়ে। কণ্ঠটা মিষ্টি নয় মোটেও। এই শহরে কোকিল নেই, কোকিলকণ্ঠীও নেই।

ফোনটা বেজেই চলেছে। কেউ কি অসুস্থ? নাকি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট? যাকগে, আমি ডাক্তারও না, পুলিশও না। দেশের ফোন ধরে মুড খারাপ করার কোনো মানে নেই। শাওয়ারের শব্দ আর গান দুটোই থেমে গেছে। জেনিফারকে একটা নাইটি গিফট করেছি, টকটকে লাল। শ্যামলা মেয়েটাকে গোসলের পর লাল জামায় পরির মতো লাগবে। আবার ভুল করলাম। এ শহরে পরি নেই। পরি থাকে ঢাকায়। ভার্সিটিতে পড়ে। রিকশায় বসে হাত ধরে থাকে। ঝড়ের দিনে হুড তোলা আড়ালে চুমু দিলে কপট রাগ করে। সেই পরিকে নিয়ে একদিন আমি ঘর বাঁধি। তারপর একদিন সে আমার মন ভেঙে দিয়ে চলে যায়। স্টকহোম খুব নিশ্চিন্ত শহর। এ শহরে কোনো পরি নেই।

জেনিফারকে দেখে আমার মুখ হাঁ হয়ে যায়। মাথা নিচু করে ফেলি। বাঙালি ছেলের বোকামি দেখে হেসে ফেলে মেয়েটা। তিন মাসের মেলামেশার (প্রেম শব্দটার অপমান করা উচিত হবে না) পর আজ আমরা একটা বদ্ধ কামরায় আটকে আছি। মন বলে কিছু নেই। শরীরটাই সব। এ রকম বদ্ধ কামরায় আরেকবার আটকে গিয়েছিলাম এক পরির সঙ্গে। আলেকজান্ডারের মতো বিপুল বিক্রমে হুঙ্কার দিয়ে রেখেছিলাম বিয়ের কয়েক মাস আগে থেকে। অথচ সে রাতেও আমি মাথা নিচু করে ফেলেছিলাম। পরি বলেছিল, ‘আহা রে, বাবু লজ্জা পেয়েছে।’ জেনিফার বলল, ‘সো সুইট।’

আমরা দুজন এখন এক চাদরের নিচে। আমার হাত খেলা করছে বাদামি চুলের বাগানে। এভাবে বিলি কেটে দিলে ঘুমিয়ে যেত পরি। জেনিফার ঘুমিয়ে গেলে অবশ্য বিপদ। নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাই অবাঙালি মেয়েটাকে। ও কিছু না বুঝেই মুগ্ধ হওয়ার ভান করে।

‘আমরা তখন কলম্বাস, হাত ছুঁয়ে দেখি আদিম আর্দ্র নির্জনতম দ্বীপের শিখর,
আমরা তখন পানামের ইটে মাখামাখি জড়ানো শতবর্ষী বটের শিকড়।’

‘হোয়াট দ্যা হেল হ্যাজ বিন ভাইব্রেটিং আন্ডার ইয়োর পিলো’ বলেই বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করল জেনিফার। ‘ওহ, ইটস ইয়োর মম। জাস্ট পিক ইট আপ বেবি। ইট কুড বি সামথিং ভেরি আর্জেন্ট। অ্যাম নট লিভিং, বাই দ্য ওয়ে।’ অগত্যা ধরতেই হলো ফোনটা। ‘শুভ, আজ তোর হলিডে, ভেবেছি বাসায় আছিস, তাই ফোন করলাম। ঘুমিয়ে ছিলি বুঝি। আমাদের টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে। মগবাজারে বাসের ধাক্কায় একটা সিএনজি দুমড়ে–মুচড়ে গেছে। ভেতরে মা, মেয়ে দুজনই স্পট ডেড। সুমি, শশী আর নেই রে বাবা।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড? আর ইউ ক্রাইং?’ আমি চোখে হাত দিয়ে দেখি জল। অশ্রু জিনিসটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। এত দিনের জমানো অশ্রু আমি আর আটকে রাখতে পারছি না। অথচ জেনিফারকে দেখাতেও পারব না। আমার একটা মন আছে কিংবা ছিল, ভাঙা মন, এই সত্যটা জানতে দেব না কাউকে।

শুধু একটা চাদরে জড়ানো জেনিফার অবাক চিৎকার করে দেখল আমি বের হয়ে যাচ্ছি। কে যেন তাড়া করছে আমাকে। স্টকহোমের মাইনাস ১৮–এর বরফে ঢাকা পথে আমি দৌড়াচ্ছি। কে তাড়া করছে আমাকে? আমার অতীত? আমার সন্দেহভরা সংসার, যান্ত্রিক মিলনের রাত, একে অন্যের পরকীয়ার অস্তিত্ব আবিষ্কারের আশঙ্কা, ঝগড়া, সন্তান? সব ঠিক হয়ে যাওয়ার মিথ্যা সান্ত্বনা, আবার ঝগড়া, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ, মামলা, ডিভোর্স? অপরাধবোধ আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। ‘আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো সুমি’—চিৎকার করতে করতে আমি ছুটছি। আমার চোখে শ্রাবণধারা। বুকে চৈত্রের আগুন। মনের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়। বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন ব্যথা করছে। ডাক্তার বলে, এখানে হৃৎপিণ্ড নামে একটা মাংসপিণ্ড থাকে। বোকা আমি জানি, এখানে মন থাকে। এখন সেখানে হাতুড়ি–শাবলের শব্দ হচ্ছে। কে যেন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে এ মন আমার।

মাতুয়াইল, ঢাকা