জীবনপুর ইস্টিশন

জীবনপুর ইস্টিশন।
জীবনপুর ইস্টিশন।


ট্রেন থেকে নেমেই চোখ পড়ল স্টেশনের নামের দিকে। জীবনপুর ইস্টিশন। চায়ের দোকানের খোঁজ করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল সামনে দাঁড়ানো এক সুন্দরী তরুণীর ওপর। দেখলাম, সে–ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই হৃদয়ের কোথাও যেন একটা নাড়া খেল। কী কারণে নাড়া খেল, তা অতীতে লুক্কায়িত। যা হোক, মেয়েটি পরিচিত, এতটুকুই জেনে রাখুন। অল্প সময়ের জন্য মনে হলো হাতঘড়িটা যেন থমকে গেল। আর বুকের ভেতর কিসের যেন একটা স্রোত বয়ে গেল!
একটু পরিচয়পর্বে আসি; আমি সেজান আর মেয়েটি অনন্যা। পড়ে ঢাবিতে আমার স্বপ্নের বিষয় আইআরে। আমাদের বাড়িও একই জায়গায়। মনে নিশ্চয়ই প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে মশাই আপনি কীভাবে এত কিছু জানেন? আরে ভাই, বুঝতেই তো পারছেন, সবকিছু কী বুঝিয়ে দিতে হয়!
নিজের সম্পর্কে বলা হয়নি। আমি চবিতে পড়ি, বিষয় বাংলা সাহিত্য।
আরিফের চিৎকারে আমার ঘোর কাটল, ও বলছে, ‘কী রে চা-স্টলে কী পেয়েছিস?’ মনে মনে বললাম, ‘শালা, ডাক দেওয়ার আর টাইম পাইলি না!’
উত্তরে কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আরিফের দিকে এগিয়ে গেলাম। দুই বন্ধু মিলে আবারও চা-স্টলের সন্ধানে বের হলাম। এই স্টেশনে এমনি ট্রেন দাঁড়ায় না। আজ কেন দাঁড়াল, তা আমাদের কারও কাছেই বোধগম্য নয়। তবে মনে হচ্ছে বেশ কিছু সময় দাঁড়াবে। চা-স্টল পেলাম, সঙ্গে নিলুকেও। আজ কত দিন পর ওর সঙ্গে দেখা, তিন–চার বছরের কম নয়। শেষ কোথায় দেখেছিলাম, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে স্কুল, কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
নিলু বোধ হয় চিপস কিনতে এসেছে দোকানে। এর মধ্য দোকানদার এসে চা দিয়ে গেল। আরিফ কখন চা দিতে বলল আমি টেরই পেলাম না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি, নিলুর সঙ্গে কি কথা বলব? না, থাক। এবার একটু অন্যদিকে মনোনিবেশ করলাম। বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে আবার লোকে কি–না–কি ভাববে। দেখলাম স্টেশনে তেমন লোকজনের ভিড় নেই, যাদের দেখা যাচ্ছে, তারাও আমাদের মতোই সদ্য ট্রেন থেকে নামা যাত্রী। কয়েকটা ছাগল ঘুরঘুর করছে স্টেশনের পশ্চিম দিকটায়।
সুমধুর কণ্ঠের সম্বোধনে মুখ ঘোরালাম, ‘আরে সেজান, কী অবস্থা?’ চেয়ে দেখি সম্বোধনকারী আর কেউ নয়, সে অনন্যা। থতমত খেয়ে বললাম, ‘ইয়ে! আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’ একটু হলেই চায়ের কাপ মাটিতে পড়ে যেত। সামলে নিয়ে বললাম, ‘তোমার কী খবর? উত্তর শোনার আগেই শোনলাম ট্রেনের হুইসেল। পাশে দাঁড়ানো আরিফ বলল, দৌড়া বন্ধু। দেখলাম দোকানদার মামার হাতে দশটা টাকা তুলে দিয়েই আরিফ দৌড়াল। অগত্যা আমাকেও আরিফকে অনুসরণ করতে হলো। ট্রেন ছেড়ে দিল।
ভেবেছিলাম অনন্যা এই ট্রেনেই উঠবে। কিন্তু না, খেয়াল করলাম, আমাদের ট্রেনের উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি। জানালা দিয়ে থাকালাম! অনন্যা দেখা মিলল না। তবে যে দুটি জিনিস চোখে পড়ল, তা হলো স্টেশনমাস্টারের হাতের দোলায়মান পতাকা আর সেই স্টেশনে প্রবেশ করার সময়ের প্রথম দৃশ্য। জীবনপুর ইস্টিশন নামক লেখাটা।
মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। প্রায় দুই মাস পর বাড়ি যাওয়ার আনন্দটা মলিন হয়ে গেল।
জীবনপুর ইস্টিশন যেমন তৈরি করল উত্তরের আকাঙ্ক্ষা। তেমনি অতীত জীবনের অপ্রকাশিত আবেগকেও যেন আরেকবার খোঁচা দিয়ে গেল..

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা