যে বেতার কেন্দ্র যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল


২৫ মার্চ রাত ১২টার পর হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণে মানুষ দিশেহারা। পুলিশ লাইন বিধ্বস্ত। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর থেকে অন্ধভাবে কিছু তরুণ মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছেন। ঠিক তখনই জন্ম নিয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। এই বেতার কেন্দ্রই সেদিন বাঙালিদের যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই ভয়ংকর রাতে নিহত হন কয়েক হাজার মানুষ। গ্রেপ্তার হন এ দেশের মাটি ও মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। গ্রেপ্তারের আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার একটি বার্তা প্রদান করে যান।
১৯৭১ সাল। ২৬ মার্চ। খুব ভোর। চট্টগ্রামের প্রধান সড়কে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা মাইকে প্রচার হয়। সে সময় স্থানীয় ডাক্তার আনোয়ার আলী ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত কর্মী। তিনি এ ঘোষণার একটি লিফলেট সংগ্রহ করেন। তাঁর স্ত্রী মনজুলা আনোয়ার এটি অনুবাদ করেন। দুপুরবেলা আরও অনেকে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণার লিফলেট হাতে পান। ২৬ মার্চ বেলা ২টা ১৫ মিনিটে আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
এবার দেশ স্বাধীনের জন্য মানুষকে একতাবদ্ধ ও সচেতন করতে হবে। করতে হবে উদ্বুদ্ধ। এ জন্য জরুরি হয়ে পড়ে প্রচারমাধ্যম। কয়েকজন বেতারকর্মী এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে তখন নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল। এ জন্য কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’।
২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে প্রথম অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। এখান থেকে সম্প্রচারের প্রথম বাক্যটি ছিল, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’। কালুরঘাটে বেতার কেন্দ্রের শক্তি ছিল ১০ কিলোওয়াট। তখনো মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়নি। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই মুক্তিবাহিনী গঠনের ডাক দেওয়া হয়েছিল।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন। এসব অনুষ্ঠান তাঁদের মনে ভীষণ আশা জাগাত। এই কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের প্রতিষ্ঠাকাল ছিল ২০ থেকে ৩০ মার্চ দুপুর পর্যন্ত। ৩০ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানি বোমারু বিমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে হামলা করে। আর এটিই ছিল বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রথম বিমান হামলা। এই হামলায় কেউ নিহত হননি। তবে বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এক বিস্ময়কর ভূমিকা রাখে। এক অর্থে এটি ছিল একটা যুদ্ধকালীন ফ্রন্ট। সে সময়ে চারদিকে হানাদার বাহিনীর হিংস্র আক্রমণ। জাতিকে সংগঠিত করা অত্যন্ত জরুরি। বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। আর এভাবে তখন জাতিকে সংগঠিত করা হয়।
বিভিন্ন এলাকা থেকে কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসতেন। সবাই এখানে আসতেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। সীমাহীন প্রতিকূলতা, বাধাবিপত্তি নিয়ে এখানে কাজ করতে হতো। তাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা অনিবার্য অংশ।
মা, মাটি, মানুষের শিকল ছেঁড়ার গান। শত্রুর বিরুদ্ধে কঠিন উচ্চারণ। নাটক, কবিতা, চরমপত্র—এসব উদ্যোগ শত্রুর মনোবল ভেঙে দেয়। প্রায় নিশ্চিত করে তাদের পরাজয়। সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে কত যে অনুষ্ঠান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার হয়েছে, তার শেষ নেই। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল চরমপত্র—ব্যঙ্গ রচনা। অগ্নিশিখা—মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠান। জাগরণী—উৎসাহ প্রদান। ইংরেজি ও বাংলা খবর। বিশ্বজনমত। ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোগ্রাম।
১০ মিনিটের উর্দু অনুষ্ঠান, বিশেষ কথিকা। বঙ্গবন্ধুর বাণী। জল্লাদের দরবার। ইয়াহিয়া ও তাঁর দোসরদের নিয়ে ব্যঙ্গ নাটিকা। দৃষ্টিপাত—বিশেষ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক মঞ্চ। কাঠগড়ায় আসামি। পিন্ডির প্রলাপ। রণাঙ্গনের চিঠি। মুক্ত অঞ্চল ঘুরে এলাম। শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান—ওরা রক্ত বীজ। পরবর্তী সময়ে সোনার বাংলা, পল্লির শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান। প্রতিধ্বনি আরও অনেক অনুষ্ঠান ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো বেতার কেন্দ্র এত বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানা নেই। স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম পর্ব ছিল কালুরঘাট, দ্বিতীয় পর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের জঙ্গলে। তৃতীয় পর্ব ২৫ মে কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে এটি বাংলাদেশ বেতার নামে চলছে।

সাংবাদিক ও সংগঠক