নগণ্য প্রেমের গল্প


এনায়েত সাহেবের রূপবতী স্ত্রীকে নিয়ে কলোনিতে কম জল ঘোলা হয়নি। এনায়েত সাহেবের স্ত্রী কবে কোন শাড়ি পরেছেন, সেই শাড়ির রং, পুরুত্ব নিয়ে বিস্তর কথা ছড়িয়েছে।
শোনা যায় ববিতা, শাবনূর যাঁর হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছেন, সেই বিখ্যাত চিত্রপরিচালক এহতেশাম স্বয়ং একবার এনায়েত সাহেবের স্ত্রীকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এনায়েত সাহেবের স্ত্রী পড়াশোনা জানা মেয়ে। এসব আলোচনা ও কানাঘুষা তাই এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আসল নিয়ন্ত্রণ। কারণ, এনায়েত সাহেবের স্ত্রীর কঠিন ব্যক্তিত্বের কাছে মন্দ লোকেদের ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে। যাকে বলে একেবারে ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়!
এনায়েত সাহেব নির্লিপ্ত ধরনের মানুষ। কেউ যদি তাকে বলে, ভাই ঘটনা শুনেছেন? পাশের এলাকায় তো কাল একটা মার্ডার হয়েছে! তিনি তখনও আচ্ছা বলে আবার হাঁটা শুরু করেন। এনায়েত সাহেব চাকরি করেন কলোনির হাসপাতালে।
এনায়েত সাহেবের স্ত্রী বাড়তি ইনকামের জন্য মুরগি পালন শুরু করলেন। তার খোঁয়াড়ে এখন এগারোটা মুরগি আছে। তিনি বারোটা দিয়েই শুরু করেছিলেন। একটা কেনার পরদিনই মারা গেছে। মাসখানেকের মধ্যেই তিনি সব মুরগিকেই আলাদা করে চিনতে পারেন।
তিনি মুরগিগুলোর আলাদা নাম দিয়েছেন। সুন্দর দেখতে একটা মুরগির নাম দিয়েছেন ঝুনঝুনি। লাল টকটকে একটা মোরগের নাম দিয়েছেন লালবাবু।
মুরগিগুলোও তার কাছে বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। মহানন্দে খাওয়াদাওয়া করছে, ঘুরছে–ফিরছে। এদের মধ্যে আবার নেতা গোছের একজনকে দেখা যায়। সে সব কিছুতেই সামনে সামনে থাকে। দেখা গেল বাকিরাও তাকে বেশ সমীহ করে চলছে। সে খাওয়া শুরু করলেই বাকিরা খায়। খোঁয়াড় খুলে দিলে সে-ই আগে বের হয়।
বৈকালিক আহারের পর একদিন দুই মুরগির মধ্যে কথোপোকথন—
প্রথম মুরগি: ঝুনঝুনি ও লালবাবুর তো হয়ে গেছে!
দ্বিতীয় মুরগি: মানে?
প্রথম মুরগি: এরা প্রেম করে। সারা দিন একসাথে ঘোরে।
এই গুঞ্জন দ্রুত সব মোরগ–মুরগির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।
ঝুনঝুনি ও লালবাবুর আসলেই প্রেম হয়ে গেছে। ঝুনঝুনিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় লালবাবু। ঝুনঝুনি তখন বলে, দেখো আমরা দুই দিনের জন্য ঘটনাক্রমে এক খোঁয়াড়ে আছি। হঠাৎ করে কে কোথায় চলে যাই, তার ঠিক আছে? লালবাবু বলে, তাই বলে কি আমাদের প্রেম মিথ্যে হয়ে যাবে? তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি, সেদিন থেকেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তুমি প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না। ঝুনঝুনি বলে, এভাবে আমাকে দুর্বল করে দিও না। শুনেছ নিশ্চয়ই আমরা এখন আর এগারোজন নেই। দুজনকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে? কে জানে কাল সকালেই হয়তো আমাদের পালা আসবে!
না তাদের পালা এখনও আসেনি। এরপর আরও অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। এখন খোঁয়াড়ে ছয়টি মুরগি আছে। লালবাবু ও ঝুনঝুনি এখনও আছে। তারা সমস্ত অনিশ্চয়তা ভুলে চুটিয়ে প্রেম করছে। কোনো মুরগি তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, প্রশ্ন করলে, লালবাবু বলে, আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড! নেতা টাইপ মুরগিটা তাদের প্রেমে বাধা হয়ে এসেছিল। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বিক্রি হয়ে গেছে।
ঝুনঝুনি ও লালবাবু তাদের খোঁয়াড়ের ছাদে বসে আছে। বিকেলের নরম আলোয় দুজনেই আজ বড় চুপচাপ। ঝুনঝুনি এই প্রথম লালবাবুর গা–ঘেঁষে বসেছে। ঝুনঝুনি বলল, আমার না—মন কেমন করছে! লালবাবু একপলক ঝুনঝুনির দিকে তাকিয়ে দূরের চালতা গাছের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি চলে গেলে তুমি কি খুব কষ্ট পাবে? ঝুনঝুনি বলল, ধুর কষ্টের কথা রাখো তো, চলো দুজন মিলে উঠানটা একবার চক্কর দিয়ে আসি। একটু পরেই তো খোঁয়াড়ে ঢুকে যেতে হবে!
পরদিন সকালে সত্যি সত্যি ঝুনঝুনি বিক্রি হয়ে গেল। সেদিন শুধু একা ঝুনঝুনিই বিক্রি হলো।
ঝুনঝুনিকে যখন নিয়ে যাচ্ছে লালবাবু তখন শোকে পাথর। ঝুনঝুনি একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। কাছে কোথাও ফুল ভলিউমে রেডিও বাজছিল-—‘ওগো সাথি আমার তুমি কিছু বলো না/ নীরবে শুধু শুধু চেয়ে থেকো না!’

ঝুনঝুনিকে কিনে নিয়েছেন তাহের সাহেব। তিনি ঢাকা যাচ্ছেন মেয়ের অসুখের খবর শুনে। এখান থেকে ঢাকা যেতে তিন–চার ঘণ্টা লাগে। যাওয়ার সময় মেয়ের জন্য এটা সেটা–নিয়ে যান। এ যাত্রায় ঝুনঝুনি আর নিজের গাছের পেয়ারা নিয়ে যাচ্ছেন।
সারা রাস্তায় ঝুনঝুনির শুধু লালবাবুর কথা মনে পড়ছিল। পেয়ারা দেখে তার পেয়ারা গাছের কথা মনে পড়ল। খোঁয়াড়ের পাশের পেয়ারা গাছের নীচেই সে প্রথম লালবাবুকে ভালোবাসি বলেছিল।
তাহের সাহেব মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনেই এসেছেন। কিন্তু এসে দেখলেন, মেয়ে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। তিনি মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন। মেয়ে বলল, তুমি এসেছ, আমি এখন সুস্থ হয়ে যাব বাবা!
সন্ধ্যাবেলা মেয়ের জামাই তাহের সাহেবের আনা মুরগি দিয়ে স্যুপ বানিয়ে আনল। মেয়েকে তিনি পরম মমতায় সেই স্যুপ খাইয়ে দিলেন এবং কী আশ্চর্য্য—স্যুপ খাওয়ার সাথে সাথেই মেয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি বাবা, আমার এখন একটুও খারাপ লাগছে না।
তাহের সাহেব দেখলেন, মেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে তার স্বামীকে সরিয়ে দিল। স্বামী–স্ত্রী পরষ্পরের দিকে তাকালো। বড় প্রেমময় সে চোখাচোখি। তাহের সাহেব চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
এই বিশ্ব চরাচরে ঝুনঝুনির প্রেম একটি ছোট্ট বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে গেল চিরদিনের জন্য। শুধু লালবাবু সেদিন সন্ধ্যায় আর খোঁয়াড়ে ফিরে এল না!