একাত্তরের দিনগুলি

মনে পড়ে একাত্তরের স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। তখন বয়স আর কতই হবে, ১৫-১৬ বছর । সবে এইচএসসি পাস করেছি। এরই মধ্যে ঘটে গেল মহাবিপর্যয়। বাবা হঠাৎ করে এ জগতের মায়া ত্যাগ করলেন। আমি সবার বড়। আমার দায়িত্ব অনেক। আমার কিছু হলে মা কি নিয়ে থাকবেন। সেসব দিনের কথা বলে তো আর শেষ হবে না। তবু অনেক স্মৃতিময় যুদ্ধের একটি স্মৃতি, যা আমার বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্তির মূলে এবং তা আমি ভুলতে পারি না। একাত্তরের নভেম্বর। তখন আমি গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার পাহাড়পুর আমবাগান ক্যাম্পে রয়েছি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। সব মিলিয়ে ক্যাম্পে ওই দিন অবস্থান করছিল ৬০-৭০ জন। আর ছিল ১৫ জন গেরিলা যোদ্ধা। খবর এল ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন আহমদ চৌধুরী পিএসসি (বীর বিক্রম, পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) দেখা করতে বলেছেন। খবর পেয়েই লালগোলা ডাকবাংলোয় কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সে সময় উপস্থিত ছিলেন সিভিল স্টাফ অফিসার বদিউজ্জামান টুনু (বীর প্রতীক)। ক্যাপ্টেন গিয়াস বললেন, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট দিই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা টহলদল প্রতিদিন রাত ১০টায় রাজশাহী থেকে গোদাগাড়ী অভিমুখে যায়। এ টহলদলের কারণে নৌকা থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক পেরিয়ে ভেতরের দিকে যেতে অসুবিধায় পড়ছে। টহলদলটাকে অ্যাম্বুশ করতে হবে। ৭ নভেম্বর রাত নয়টায় পদ্মা পার হয়ে একটা মেঠোপথ ধরে স্পটে এসে পৌঁছালাম। আসার পথে নদীর তীর পর্যন্ত রিট্রিট করার পথটা রেকি করে নিলাম। কসবা আখ সেন্টার। সামনেই রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ হাইওয়ে। ঠিক বাঁকটার দক্ষিণে অবস্থান নিলাম। রাস্তাটা ওখান থেকে পূর্ব-উত্তর দিকে হঠাৎ ঘুরে গেছে। রাস্তার উত্তর দিকে একটা বড় পুকুর। অ্যাম্বুশের জন্য উপযুক্ত স্থান। রাস্তায় এসে একটা ঝোপ বুঝে সাদা কাপড় বেঁধে নিলাম, যাতে করে জিপ বা লরির আলো এসে পড়লে ওটা দেখা যায়। কিন্তু ওটা শত্রুর নজরে আসবে না। ফিরে এসে অ্যাম্বুশ পার্টিকে ব্রিফ দিলাম। ঝটপট লাইন ফরমেশন দিতে। এখন শত্রুর জন্য অপেক্ষা। রাত ১০টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলটির গাড়িবহর রাজশাহী শহরের দিক থেকে আসবে।শুরু হলো অধীর প্রতীক্ষা। সবাই রুদ্ধশাস। এই বুঝি এসে পড়ল শত্রুর লরি। কিন্তু ১০টা পেরিয়ে গেল, শত্রুর দেখা নেই। এক মিনিট দুই মিনিট করে পেরিয়ে গেল দেড় ঘণ্টা। তবে কি অপারেশন ব্যর্থ হবে! ভাবলাম, শত্রুর টহল গাড়ি আজ আসবে না—এমন সময় পশ্চিম দিকে দুটো গাড়ির আলো দেখা গেল। কিন্তু পশ্চিম দিক থেকে কেন? শত্রুর টহল আসার কথা পূর্ব দিক থেকে। পরে খোঁজ পাই সেদিন গোদাগাড়ীতে পাকিস্তানিদের একটা সমাবেশ ও আলোচনা সভা ছিল। তাই সন্ধ্যার দিকেই তারা গোদাগাড়ী চলে গিয়েছিল। ওখান থেকে ফিরছিল রাত সাড়ে ১১টার দিকে। হঠাৎ আমাদের পজিশন থেকে দেড় হাজার গজ দূরে থেমে গেল এবং মিনিট পাঁচেক পরে লরিটি ফিরে গেল গোদাগাড়ীর দিকে আর জিপটি আসতে লাগল। শত্রুর জিপের ওপর মেশিনগান বসানো। আমরা অ্যালার্ট হয়ে গেলাম। জিপটা সাদা কাপড় বাঁধা ঝোপের কাছে আসতেই গর্জে উঠল সব হাতিয়ার। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত গুলিবৃষ্টিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল শত্রুর জিপটি। জিপের চাকা ও লাইট নষ্ট হয়ে গেছে প্রথম আঘাতেই। ভারী অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ করার কোনো সুযোগ পেল না। মুক্তিযোদ্ধারা সমানে গুলি চালাচ্ছে। কিন্তু পাল্টা উত্তর এল না একবারও। কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে সবাই একসঙ্গে উঠে এসে শুরু করলাম চার্জ। শুরু হলো সার্চ। এক আর্মির লাশ পড়ে আছে জিপ ঘেঁষে। একজন সহযোদ্ধা বলে উঠল, নড়ছে। কারও বিপদ হতে পারে ভেবে এসএমজির পুরো ম্যাগাজিনই খালি করলাম লাশটার ওপর। তারপর হলো সার্চ। দেখলাম খোলা জিপে মেশিনগানের গানারের নিষ্প্রাণ দেহটা পেছন দিকে জিপের রডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত সার্চ সেরে ফেরার পালা। হঠাৎ দেখি, পূর্ব দিক থেকে, অর্থাৎ রাজশাহীর দিক থেকে, ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসছে পাকিস্তান সেনারা। ভয় নেই, শত্রুর হাতিয়ার বিধ্বস্ত। ওয়্যারলেস সেট এবং কোনোরকমে মেশিনগানের নলটা খুলেই বললাম, মুভ। সবশেষে ফেরার পথে শত্রুর জিপের ওপর পর পর পাঁচটি ফায়ার গ্রেনেড ছুড়লাম, ফাটল না একটাও। জেদ চেপে বসল ঘাড়ে। না জিপটা ধ্বংস না করে যাব না। ছুড়লাম থার্টিসিক্স গ্রেনেড। ব্যস, কাজ হলো। একযোগে পাঁচটি ফায়ার গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল পাক বাহিনীর জিপ। মুভ, নদীর ধারে এসে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার জন্য নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা কোয়ার্টার মাইল যেতেই শত্রুর মর্টার এসে পড়তে লাগল পদ্মার চরে। ভয় নেই, আমাদের নৌকা থেকে অনেক দূরে।এখন দেশ স্বাধীন, আমি স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন সৈনিক। বাঙালি পেল একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতি আমাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করল। আমি গর্বিত, আমি ধন্য।