জাপানিজ স্ত্রী

আঁকা: স্বপন চারুশি
আঁকা: স্বপন চারুশি


নানাকা ইয়মাদা। আমার একমাত্র জাপানিজ বন্ধু। লম্বায় ৫ ফুট, গড়নে পাতলা ছিমছাম, অন্যদের চেয়ে ছোট আকৃতির কালো চোখ, আর সাদা গালের ওপর ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক। আনিন্দ্য সুন্দর মেয়েটি ক্লাসের সবার চাইতে আলাদা। আর আমার জাপানিজ ভাষায় দক্ষতার কারণে আমাদের মধ্যে সক্ষাৎ একটু বেশি। তা ছাড়া আমরা প্রতিবেশী।
আমার আর নানাকার ঘর অনেকটা মুখোমুখি। আমার বাইরের জানালা দিয়ে ওর ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। আর এই দুই বাড়িকে আলাদা করেছে একটি ৫ ফুট প্রস্থ রাস্তা। এই ছোট দূরত্ব দুটি আলাদা সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ভিন্ন দুই মানুষের। আমরা দুজনেই সমবয়সী, এই কারণে আমাদের মধ্যে মান আর অভিমান লেগেই থাকে। আর এই এলাকায় আমাদের ভাষা বোঝার মানুষের বড়ই অভাব। তাই আমাদের অতি অল্প কারণে অভিমান যেমন হয়, আবার সেই অভিমান ভাঙতেও সময় লাগে না। নানাকার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান আর আমার জাপানিজ ভাষাজ্ঞান অনেকটা একই। তাই নানাকাকে ইংরেজি শেখানোর চেয়ে ওর কাছ থেকে জাপানিজ শেখাটাই আমার কাছে বেশি লাভের। আর সব মিলিয়ে এই দূর পরবাসে আমরা বাংলাদেশি আর জাপানিজ আছি পাশাপাশি।
বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় আমার দিন কাটে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে পরীক্ষাও শেষ। শিক্ষাবৃত্তিও প্রায় শেষ। তাই একলা ঘরে সারা দিন আর মন মানে না। নিজের জীবন আজকাল পশুর মতো মনে হয়। পশুর যেমন সারা দিন খাবার খোঁজা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, আমারও ঠিক তা–ই। এমতাবস্থায় বাইরে ঘুরতে যেতে বড্ড মন চায়। করোনা সারা পৃথিবীতে অগ্নিরূপে বিস্তার লাভ করলেও মধ্য জাভায় প্রভাব একটু কম। তারপরও সাবাই নিজ দায়িত্বে গৃহবন্দী। মনটা আজকাল বাড়ির জন্য খুবই ছটফট করে।
ঘড়িতে রাত ১টা। বিছানার ওপরে থাকা মোবাইল ফোনটি উচ্চ শব্দে বেজে উঠল। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখি নানাকার ফোন।
ভারী গলায় ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল, ‘আমি অসুস্থ। হাসপাতালে যাব। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?’
একমাত্র আমি ছাড়া এই জাভায় নানাকার আপন বলে কেউ নেই। আর এই মধ্যরাতে কোনো যুবতী নারীর আবদার কি অমান্য করা যায়?
আমি বললাম, ‘নিচে নামো, আমি আসছি।’
রাতের জাভা খুবই ঠান্ডা। তাই শার্টের ওপর হুডি, জিনস আর কেডস পরে দ্রুতই নিচে নামলাম। বাসার নিচে নামতেই দেখি নানাকা স্কুটি নিয়ে আমার জন্য আমার বাসার নিচে অপেক্ষা করছে। বরাবরই আমি নানাকার ড্রাইভার। আমার ড্রাইভিংটা ওর বিশেষ পছন্দ। করোনার আগে আমরা জাভার পাহাড়, পর্বত, সাগর, ঐতিহাসিক–অনৈতিহাসিক জানা–অজানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি।
এই মধ্যরাতের নানাকা আর অন্যদিনের নানাকার মধ্যে পার্থক্য অনেক। গলাটা খুবই ভারী আর কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। একসঙ্গে চলাফেরার কারণে নানাকা কিছুটা বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশিদের বুঝে।
আচমকাই নানাকা বলল ‘তুমি আজকে আমার স্কুটি চালিয়ো না। আমার মনে হচ্ছে আমার মধ্যে করোনার প্রভাব বিদ্যমান।’
হঠাৎ করেই এ কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। আমার উপস্থিত বুদ্ধিও আর কাজ করছে না। যে মেয়েটি কয়েক দিন আগে আমার পেটে ব্যথায় হাসপাতাল থেকে শুরু করে আমার রুমে খাবার রান্না করে দেওয়া ছাড়াও প্রতি সন্ধ্যায় আমার মন ভালো রাখার জন্য গিটারের সুরে সুর মেলাত, আজকে তারই করোনা। যা–ই হোক, আমি বাংলাদেশি, আমার কাছে মানবিকতাই আসল। এই শীতের রাতে ঠান্ডায় আক্রান্ত কোনো নারীকে মোটরসাইকেল চালাতে দেওয়া আমার বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী। তাই নানাকার সঙ্গে আর বেশি কথা না বাড়িয়ে নিজেই চালকের আসনে বসে পড়লাম।
ঘড়ির কাঁটায় রাত ২.৩০ মিনিট। রাস্তায় দু–একটি মোটরসাইকেল ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। তারপরেও কেউ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে না। এরই মধ্যে আবিষ্কার করলাম, নানাকা ওর মুখ আমার পিঠের সঙ্গে লাগিয়ে পেছন থেকে হাত দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরেছে। মধ্যরাতের রোমান্টিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়।
অতিদ্রুতই আমরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। হাসপাতালটি অনেক পরিষ্কার আর আয়তনে বড়। কোনো এক খ্রিষ্টান নারীর নামের সঙ্গে মিলে রাখা হয়েছে এর নাম বেথেসদা। কিছুদিন আগেই আমি এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে গেছি। তাই এই হাসপাতালের সবকিছুই আমার পরিচিত থাকায় ডাক্তার পেতে কোনো সমস্যা হলো না। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর দেখি নানাকার শরীরে করোনার কোনো লক্ষণই নেই। আর হাসপাতালে আসতে পেরেই নানাকা ৮০ ভাগ সুস্থ। হঠাৎই দেখি, নানাকার বাম হাতের তালু বরাবর ব্যান্ডেজ আর ডাক্তার নিজেই সেই ব্যান্ডেজ খুলছেন।
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সারা দিন আপনি বাসায় কী করেন? বউয়ের দিকে কি আপনার কোনো খেয়ালই নেই? হাত কাটার চার ঘণ্টা পর হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন! এই করোনার সময় দুজনে মিলে বাড়ির কাজ করলে আজ কি এই অবস্থা হয়!’ পাশেই দেখি নানাকা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আর আমি খুঁজে পেলাম আমার জাপানিজ স্টাডিজে পড়ার সার্থকতা।