মিসর মন্দিরের গল্প

আবু সিম্বলের জোড়া মন্দির। ছবি: সংগৃহীত
আবু সিম্বলের জোড়া মন্দির। ছবি: সংগৃহীত

এক ছিল রাজা। তাঁর ছিল এক রানি। মিসরের যে প্রাসাদেই পা রাখি, শুরুতেই এই কথা কানে আসত আমাদের। আর অমনি ৩০ জনের প্রাণচঞ্চল দলটিতে নেমে আসত নীরবতা, তাদের চোখগুলো হয়ে উঠত কৌতূহলী। কারণ, এবার স্থানীয় গাইডের মুখে গল্প শোনার পালা! আন্তর্জাতিক একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বছরের শুরুতেই দেড় মাসের মিসর ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমি এবং বাংলাদেশের আরও দুজন শিক্ষার্থী (আতিক রাফি ও আকিব ওয়াদুদ) মিলে পাড়ি জমাই পিরামিডের দেশে। বাংলাদেশ ছাড়াও এই ভ্রমণে অংশ নেয় ফ্রান্স, গ্রিস, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ভারত ও মিসরের শিক্ষার্থীরা। এই দেড় মাসে মিসরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সব ঐতিহাসিক স্থান দর্শনের সুযোগ হয় আমাদের। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই, তবে একবিংশ শতাব্দীতেও মিসরের মানুষের পুরাণতত্ত্বের ওপর বিশ্বাস ও ইতিহাস সংরক্ষণের চর্চা আমাদের সব থেকে বেশি অবাক করেছে। সে রকমই কয়েকটি প্রাসাদের গল্প তারুণ্যের পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।

মিসরের রাজা-রানিরা মূলত নিজেদের দেবতা বলেই দাবি করতেন। তাই তাঁদের প্রাসাদগুলোকেও মিসরীয়রা ‘দেবতার ঘর’ বা মন্দির হিসেবেই জানে।

১. কর্ণক মন্দির।
মিসরে আমরা প্রথম যে মন্দির দেখতে যাই, সেটি ছিল দেশটির লুক্সর প্রদেশের ‘কর্ণক’ মন্দির। এর প্রবেশপথটিই আমাদের অবাক করার জন্য যথেষ্ট ছিল। দ্য মামি এবং জেমস বন্ড সিরিজের দ্য স্পাই হু লাভড মি–এর মতো বিখ্যাত সিনেমাগুলোতে দেখা স্থান জলজ্যান্ত আমাদের চোখের সামনে। মন্দিরটি তৈরি করতে ব্যবহৃত একেকটি পাথরের ওজন ৫ মণ। হাজার বছর আগে এত ভারী পাথর কীভাবে বহন করা হয়েছিল এবং কীভাবে এত উঁচুতে ওঠানো হয়েছিল, তা ভাবায় আমাদের। এই নিয়ে লুক্সরের মানুষদের মধ্যেও মতভেদ আছে। কেউ মনে করেন, সেই সময়ের প্রযুক্তি বর্তমান প্রযুক্তি থেকেও ১০০ গুণ বেশি উন্নত ছিল, যা একসময় ধ্বংস হয়ে গেছে কোনো দেবতার ক্রোধে। আবার কেউ বিশ্বাস করেন অলৌকিকতায়। তাঁরা বলেন, দেবতারা অলৌকিক শক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন এই মন্দির। মিসরীয় দেবতা রামসিসের (দ্বিতীয়) একটি মূর্তি সেখানে রয়েছে, যার পায়ের কাছে তাঁর স্ত্রীর মূর্তি খুব ছোট করে তৈরি করা। এর অর্থ, দেবতার সমকক্ষ কেউ নয়। এ ছাড়া মূর্তিটিতে দেখা যায় রামসিসের বাঁ পা সামনে অগ্রসর করা। বাঁ দিকে হৃৎপিণ্ড থাকায় দেবতা তাঁর সব সিদ্ধান্ত নেবেন হৃদয় দিয়ে, এটিই মিসরীয়দের বিশ্বাস।
মন্দিরটির পেছনের দিকে একটি বড় গভীর দিঘি রয়েছে, যেটি নীল নদের সঙ্গে সংযুক্ত। এই দিঘিকে পবিত্র এবং গোপন দিঘি বলা হয়, কারণ এখন পর্যন্ত নীল নদের সঙ্গে এর সংযুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বলা হয় রামসিস (দ্বিতীয়) এই পুকুরে স্নান করে শুদ্ধি লাভ করতেন।

২. লুক্সর মন্দির।
নীল নদের তীর ঘেঁষে এই মন্দির নির্মাণ করেন তুতেনখামন আর রামসিস (দ্বিতীয়)। লুক্সর শহরের নামকরণও হয়েছিল এই মন্দিরকে ঘিরেই। আকারে ছোট এই মন্দিরকে দিনের আলোতে যেমন দেখায়, রাতে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেলেপাথরে তৈরি মন্দিরটি রাতের আলোকসজ্জায় এক অলৌকিক আবহ তৈরি করে।
বলা হয়, মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করে। এর প্রবেশপথে রয়েছে দুটি পিলার, যাদের চূড়াগুলো সোনায় তৈরি পিরামিড আকৃতির। আর পিলারগুলোর নিচে কয়েকটি বানর মাটির দিকে মুখ করে রাখা। কৌতূহলী কেউ কেউ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারলাম, ভোরের সূর্যরশ্মি যখন সোনার পিরামিডে প্রতিফলিত হয়, তার দিকে সরাসরি তাকালে তা সূর্য দেবতাকে রুষ্ট করতে পারে। তাই প্রাণী মূর্তিগুলোকে এভাবে তৈরি করা হয়েছে।
এই মন্দিরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর মধ্যে একটি মসজিদ ও একটি গির্জাও রয়েছে, যা ধর্মনিরপেক্ষতার নিদর্শন। মন্দিরটিতে দেবতা তুতেনখামন ও সূর্য দেবতার মূর্তি পাওয়া যায়, যেখানে একই উচ্চতায় পাশাপাশি তাঁদের স্ত্রীদেরও মূর্তি রয়েছে। একই উচ্চতায় মূর্তি নির্মাণের মধ্য দিয়ে মন্দিরটিতে লিঙ্গসমতাও লক্ষ করা যায়। মিসরের ৪২টি প্রদেশকে চিত্রিত করা হয়েছে এর ৪২টি পিলারের গায়ে, যা লুক্সর মন্দিরের অন্যতম নিদর্শন।

৩. আবু সিম্বলের জোড়া মন্দির।
আবু সিম্বলে পাশাপাশি দুটি মন্দির রয়েছে। একটি রামসিসের (দ্বিতীয়), অন্যটি তাঁর অষ্টম নুবিয়ান স্ত্রী নেফারটারির। প্রথম মন্দিরটির প্রবেশদ্বারে রামসিসের চারটি মূর্তি রয়েছে। এই চার মূর্তিকে চার দিকের রক্ষক মনে করেন মিসরীয়রা। আগের মতোই এখানেও তাঁর পায়ের কাছে স্ত্রী নেফারটারির ক্ষুদ্রাকৃতির অবস্থান। রানি নেফারটারির মন্দিরটিও তুলনামূলক ছোট।
মন্দিরটির ভেতরে একদম শেষ প্রান্তে চারজন ভিন্ন দেবতার মূর্তি রয়েছে। তাঁরা হলেন দেবতা ‘রা’, ‘আমন’, রামসিস (দ্বিতীয়) এবং অন্ধকারের দেবতা। মন্দিরটির সব থেকে চমকপ্রদ অংশ হলো সূর্যের প্রথম আলো এই মূর্তিগুলোর ওপর সরাসরি পড়ে। তবে শুধু অন্ধকারের দেবতা অন্ধকারেই থেকে যায়। কারণ, সূর্যরশ্মি তাঁকে ছোঁয় না। ভোর হওয়ার আগেই কেন মন্দিরটির সামনে গেলাম না, এই নিয়ে বোধ হয় সবাই একটু–আধটু আফসোস করেছে।

৪. হাসিপসুত মন্দির।
মিসরের একমাত্র মন্দির, যার নামকরণ হয়েছে কোনো রানির নামে।
রাজা তুতমোসা (দ্বিতীয়)র সঙ্গে বিয়ে হয় হাসিপসুতের। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান ছিল। কিন্তু শুধু একজন পুরুষই হতে পারে ভবিষ্যৎ রাজা। তাই তুতমোসা (দ্বিতীয়) আবারও বিয়ে করেন এবং এবার তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। এর মাত্র দুই বছর পরই মৃত্যু হয় রাজার। পরবর্তী রাজা তুতমোসা (তৃতীয়) তখনো শিশু। রানি হাসিপসুত কৌশলে শিশু তুতমোসাকে (তৃতীয়) মিলিটারি প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দেন এবং তাঁর মাকে হত্যা করে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেন। এরপর শিশু রাজার একমাত্র অভিভাবক হিসেবে দীর্ঘ ১৮ বছর সিংহাসনে রাজত্ব করেন হাসিপসুত ও তাঁর কন্যা। মিসরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী, যে এত লম্বা সময় সিংহাসনে ছিলেন। কিন্তু বাদ সাধে ১৮ বছর পর যখন তুতমোসা (তৃতীয়) তাঁর মিলিটারি প্রশিক্ষণ শেষে নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন। সৎ পুত্রকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজ কন্যার সঙ্গে তুতমোসার (তৃতীয়) বিয়ে দেন হাসিপসুত। ফলে তাঁর মেয়ে রানির আসন পায়। কিন্তু মায়ের হত্যাকারীকে বেশি দিন বেঁচে থাকতে দেননি নতুন রাজা। সৎ মা হাসিপসুত এবং তাঁর মেয়েকেও হত্যা করেন তুতমোসা (তৃতীয়)। এভাবেই রানি হাসিপসুতের রাজত্বকালের ইতি ঘটে। এই মন্দিরেই সমাহিত করা হয়েছে তাঁকে। মন্দিরটির বাইরের অংশ মিসরীয় কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত অনেক সিনেমায় দেখা গেছে।

৫. ফিলায় মন্দির।
মিসরীয় শব্দ ফিলায় অর্থ ‘শেষ’। মিসরের আসওয়ানে নীল নদের একটি দ্বীপে এই মন্দির অবস্থিত।
দুর্যোগ ও হিংস্রতার দেবতা ছিলেন ‘সেথ’। তাঁর বড় ভাই ‘ওসিরিস’ ছিলেন শান্তিপ্রিয় দেবতা। নিজ ভাইয়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সেথকে ঈর্ষান্বিত করে। সেথ কৌশলে তাঁর ভাইকে হত্যা করেন এবং ওসিরিসের দেহকে টুকরো করে সেই অংশগুলোকে রাজ্যের একেক প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। ওসিরিসের স্ত্রী দেবী ‘হাথর’ তখন তাঁর ডানার সাহায্যে উড়ে স্বামীর দেহখণ্ডগুলোকে খুঁজে বের করেন এবং ফিলায় মন্দির থেকে অনেক দূরে সিওয়া রাজ্যে সমাহিত করেন। এদিকে ওসিরিসকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে চান ওসিরিস ও হাথরের পুত্র হোরাস। শক্তিশালী সেথের সঙ্গে যুদ্ধে অনেকবার ব্যর্থ হওয়ার পরও হাল ছাড়েন না তিনি। একপর্যায়ে সেথকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন হোরাস।
ফিলায় মন্দিরের প্রতিটি দেয়ালে দেবতা হোরাসের জীবনযাপনের অনেকটাই চিত্রিত রয়েছে। চিত্রগুলোতে দেখা যায় মানুষেরা দেবতাকে খুশি করতে ফুল, ফল ও সুগন্ধি উপহার দিত। আর সর্বক্ষণ হোরাসকে পরামর্শ ও শক্তি জোগাতে পাশেই অবস্থান করতেন তাঁর মা দেবী হাথর। হোরাসের মূর্তিগুলোতে দেখা যায় তাঁর এক চোখ নেই। সেথের সঙ্গে এক যুদ্ধে দুই চোখই হারিয়েছিলেন হোরাস। পরে হোরাসের স্ত্রী তাঁকে নিজের একটি চোখ দিয়ে দেন।

‘গডস অব ইজিপ্ট’ সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে ফিলায় মন্দিরের গল্প নতুন নয়। পুরো সিনেমাই নির্মিত হয়েছে এই ইতিহাসের ওপর। সবশেষে বলতে চাই, গল্প হোক বা সত্যি, দেশটির মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকুক পুরাণ। আর পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাস বেঁচে থাকুক আমাদের মধ্যেও।

লেখাটি প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্যে’র অষ্টম সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) থেকে নেওয়া।