এক আকাশ ছায়া

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

তখন মাত্র তিন বছর বয়স আমার। বাবার সরকারি চাকরি। পোস্টিং ছিল মাদারীপুরের টেকেরহাটে। বাবার সঙ্গে সঙ্গেই তখন থাকতাম, যখন যেখানে পোস্টিং হতো। পরিবারে আমি তখন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ২০ বছর আগে, ঠিক এমন এক গ্রীষ্মকাল। বিকেলে মা ঘরের কোনো এক কাজে ব্যস্ত। আমি বাসার সামনে খেলছি। হঠাৎ প্রতিবেশী এক বাচ্চা, খুব সম্ভব তার বয়স তখন ৫ বছর। হাতে তার পাকা আম। বাজারে তখন পাকা আম কেবল উঠতে শুরু করেছে।

প্রতিবেশী বাচ্চাটি আমার দিকে তাকিয়ে আম খাচ্ছে, আমিও লোভে পাকা আমের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছি। কখন যেন সে আমের এক টুকরা খোসা মাটিতে ফেলেছে। পাকা আমের খোসা আমি দেখতে পেয়েই হাতে তুলে নিই। হাতে তুলেই দিতে যাই এক চাটা! ঠিক তখনই পেছন থেকে কোমরের ওপর পড়ল এক বিরাট চড়!

আমি তো হতবাক। সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম। মা ঘর থেকে ছুটে এসে দেখেন বাবা আমার হাত থেকে আমের খোসা ফেলছেন ও কান ধরে বাসার দিকে টেনে আনছেন। মাকে রাগের সুরে বললেন, ‘মেয়ে রাস্তাতে অন্যের খাওয়া আমের খোসা খাচ্ছে!’

অন্যদিকে তখন আমার কান্নার মাত্রা চরমে। বাবা অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই আবার বেরিয়ে গেলেন। আমি তখনো সুর করে কাঁদছি। মা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করেই চলছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পরে এশার আজানে। চোখ খুলে দেখি, এক ঝুড়ি পাকা আম! বুঝতে বাকি রইল না, বাবা এনেছেন। আমার ডান পাশে বাবা, বাম পাশে মা বসে আছেন। ঘুম ছেড়ে উঠেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরি।

মা আমার কোমরে হাত দিয়ে মলম ডলে দেন। বলেন, হাতের পাঁচটি আঙুলের ছাপ বসে গেছে। তখন আমি ব্যথা ভুলে আম খেতে ব্যস্ত হয়ে যাই। আম পেয়ে তখন সব ভুলে গেলেও ছোটবেলার এ মধুর স্মৃতি আমার আজও মনে গেঁথে আছে। বাবা ওই প্রথম আর ওই শেষ আমাকে মেরেছিলেন। এমন হাজারো স্মৃতি নিয়ে কেটে গেল ২৩টি বছর।

এখন বাবা অফিস থেকে ফিরে সপ্তাহে ৩ দিন আমার আর ছোট বোনের মাথায় তেল দিয়ে দেন, চুল বেণি করে দেন। আরও নানা রকম বড় থেকে ছোট সব আবদার বাবা মিটিয়ে আসছেন। আজও বাবা মানে এক আকাশ ছায়া।

এখন আমি বড় হয়েছি, চেষ্টা করছি আমি যেন বাবার ছায়া হতে পারি। বাবা এখন মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে খুব পছন্দ করেন। তাই এ বছর ঈদে বাবাকে ভালো একটি মোবাইল উপহার দিয়েছি। পৃথিবীর সব দামি, সব ভালো কিছুও যদি বাবাকে দিই, তবুও তাঁকে আমার ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে পারব না। বাবা যতটা ভালোবাসা, যত্ন, দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বড় করেছেন, তা যদি দ্বিগুণ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিই, তবুও চিরঋণী হয়েই থাকব।