স্বস্তির টানে ঘুড়ির পানে

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

গ্রীষ্ম শেষে বর্ষায় পা রাখল সময়। এই ঋতুর রঙের শেষ নেই। কখনো আকাশে ফুটে ওঠে ঝলমলে রোদ, খানিক পরেই রোদ ঢাকা পড়ে কালো মেঘের ভেলায়। আবার কখনো হয়ে যায় একপশলা বৃষ্টি। বৃষ্টিতে স্নান করে সবুজ প্রকৃতি। মাটি ভিজে যায়। মাটির ভেজা গন্ধে ভিজে যায় মানুষের মন। গ্রামের পথে হাঁটতে থাকলে যত দূর চোখ পড়ে, দেখা যায় নিবিড় সবুজ মাঠ। আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায়, মুক্ত প্রকৃতিতে রঙিন ঘুড়ির মেলা। কী ভাবছেন? এই বর্ষায় ঘুড়ি খেলা কিসের? হ্যাঁ, এই বছর এই মেঘলা আকাশেও চলছে ঘুড়ির লড়াই। বিকেলে বাড়ির উঠানে বা ছাদে গিয়ে একটু আকাশের দিকে তাকাবেন, দেখবেন রঙিন ঘুড়ির মেলা। মুক্ত প্রকৃতিতে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কেউ যখন আকাশের দিকে তাকায়, তখন মনটাও উদার হয়ে যায়। যে উদারতার শিক্ষা দেয় আমাদের লোকসংস্কৃতি। যার সঙ্গে রয়েছে আমাদের নাড়ির টান। তবে এই বছর যেন প্রকৃতিও শিক্ষা দিচ্ছে, বিপদে যে নাড়ির টানে ফিরতেই হয়!

করোনার কারণে আজ ক্লান্তি আর অবসাদে ঢেকে গেছে গোটা বিশ্ব। সবকিছু যেন স্থবির। কোথাও কোনো চঞ্চলতা নেই। করোনার ভয়াবহতায় বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলা মানুষগুলোও হয়েছে ঘরবন্দী। একটু স্বস্তির জন্য ইচ্ছা থাকলেও কেউ যেতে পারছেন না ক্লাব, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, পার্টি কিংবা খেলার মাঠে। দিতে পারছেন না মন খুলে আড্ডা। কোথাও কেউ নেই, তবু যেন কত সংকোচ। কাউকে স্পর্শ করা যাবে না, অনেক দিন পরে দেখা হওয়া বন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধও রাখা যাবে না। কত বাধা জীবনে। কখনো মা–বাবা ছেড়ে আসছেন সন্তানদের, আবার ছেলেমেয়েরা অনেক সময় মৃত্যুভয়ে মা–বাবার লাশও আনতে যাচ্ছেন না। এই পৃথিবীতে কেউ যেন কারও নয়। যে ছেলেমেয়ে একসময় মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপে ডুবে থাকত, তাদেরও আজ এসবে মন বসে না। অবসাদে ঢেকে গেছে সবকিছু। এখন শুধু খোলা আছে মুক্ত আকাশ। যে আকাশ সবার জন্য সমান। আজ যে আকাশে নেই বিমান ওড়ার শব্দ, সেই আকাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। সেখানে কোনো অবসাদ নেই। আছে স্বস্তি। যে স্বস্তির খোঁজে মোবাইল ফোনে ডুবে থাকা ছেলেটিও আজ ছুটছে ঘুড়ির পানে। মুক্ত আকাশের গন্ধ নিতে।

পাতলা কাগজের সঙ্গে চিকন কঞ্চি লাগিয়ে ঘুড়ি তৈরি করার মজাই আলাদা। সাধারণত দূরত্ব রেখেই ঘুড়ি ওড়াতে হয়। তা না হলে সুতোয় ‘জটলা’ বাঁধার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই খেলার করোনা ছড়ানোর ভয় কম। যে কারণে করোনাভাইরাস ঘুড়ি ওড়ানো থেকে মানুষকে বঞ্চিত করতে পারেনি। বরং লকডাউনে শিশু ও যুবকদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের কর্মহীন মানুষও এ ঘুড়ি ওড়ানোয় মেতে উঠছে। বিকেল হলেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘুড়ি উড়তে শুরু করে। এ যেন মেঘলা আকাশে ঘুড়ির মেলা। আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় বিভিন্ন রঙের ঘুড়ি। বর্ষার দস্যি বাতাসের সঙ্গে লড়াই করে আকাশে ঘুড়ি উড়ে চলে। নিজের তৈরি ঘুড়ি আকাশে ওড়ার পর সৃষ্টির যে আনন্দ, তার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনাই চলে না।

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

একসময় নিঝুম, নিস্তব্ধ ভাব নেমে আসে চারদিকে। সূর্য হেলে যায় পশ্চিমের আকাশে। ঠিক তখনই ঘুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের ব্যস্ত ছেলের দল। সারা দিন তারা করে চলে ঘুড়ি তৈরি বা মেরামতের কাজ। ছোট-বড় হরেক রকমের ঘুড়ি। সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া, নাটাই তৈরি, ঘুড়িতে বিভিন্ন ধরনের লাইট লাগানো। সব মিলিয়ে ছেলেমেয়েদের যেন কাজের শেষ নেই। আবার অনেক সময় ঘুড়ি কিনেও আনা হয়। দশ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুড়ি রয়েছে। যার ফলে ঘুড়ির জন্য দুবেলা দুটো ভাতও জুটে যায় অনেকের। যে কারণে বিষণ্ণতা যেন একটু কমই ছায়াপাত ফেলেছে গ্রামের এই শান্তিপ্রিয় মানুষদের ওপর। ঘরের চালে কিংবা ত্রাণের চালে দুবেলা দুমুঠো খাচ্ছে আর মনের সুখে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। যাদের পেটে তখনো একটু খাবার জোটেনি, তারাও যেন মুক্ত আকাশে সুতোয় বাঁধা ঘুড়ির সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে।

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের এই ব্যস্ত কিশোরেরা ঘুড়ি নিয়ে চলে যায়, ফসলের খেতের পাশে খোলা আকাশের নিচে। গ্রামীণ ফসলের মাঠজুড়ে নামে ঘন কালো অন্ধকার। গ্রামের যুবকেরা ঘুড়ির সঙ্গে বেঁধে দেয় অন্য একরকম সুতো কিংবা হরেক রঙের লাইট। রাতের অন্ধকারে যা জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। বাতাসের ছোঁয়ায় কেমন একটা মধুর শব্দ হয়! ঘুড়ি আকাশে হারিয়ে গেলেও সেই শব্দটা যেন শোনা যায়। বিকেল থেকে সারা রাত অবধি ঘুড়ি আপন গতিতে আকাশে উড়তে থাকে। সঙ্গে চলতে থাকে হইহই রইরই শব্দ। এই হট্টগোল গ্রামের অন্য মানুষের ঘুমও যেন ঘুড়ির সঙ্গেই উড়ে যায়। আকাশে উড়ে সেই ঘুড়ি, রাতজাগা হরেক রঙের ঘুড়ি। স্বস্তি নেমে আসে অবসাদের এই পৃথিবীতে।

শিক্ষার্থী, ফোকলোর বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]