মিছিলের 'চা'

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

সময়টা ১৯৯৬–৯৭, বয়স ৪–৫ হবে। গ্রামে থাকি, স্কুলে সম্ভবত যাওয়া শুরু করিনি অথবা মাত্র শুরু করেছি।

ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছিল। নির্বাচন, মিছিল, মিটিং নিয়ে বড়দের পাশাপাশি বাচ্চাদের বিশাল কৌতূহল। অনেক মানুষের জমায়েত। একসঙ্গে নির্দিষ্ট নাম ও প্রতীকের প্রচারণা। চায়ের স্টলে জটলা, মোড়ে মোড়ে গুঞ্জন। শহরে থাকা গ্রামের মানুষের ফিরে আসায় মুখরিত চারদিক। এ যেন সুবিশাল উৎসব আয়োজন! যে আমি ঈদকে সবচেয়ে বড় উৎসব মনে করতাম, সে আমার মনে হতে লাগল হয়তো ঈদের চেয়েও বড় আচার হলো নির্বাচন!

নির্বাচন তখন আমার বয়সী ছেলেদের কৌতূহল এবং আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু। তার কারণ হলো চা! চা তখন গ্রামে কেবলই বড়দের ব্যাপার। চায়ের স্টলে কেবল মুরব্বিরাই বসেন, তাঁরাই চা খান, বিশাল শব্দ করে খান, সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ। এই শব্দ কেবল বড়দের এবং বড় লোকদের খাবার বলেই হয়তো এতটা আগ্রহ হতো, চা খাব। না জানি কেমন খেতে হবে, কতই না সুস্বাদু, কতই না মজার! চা কেবল তখন স্টলেই পাওয়া যেত। এমনকি ব্যবহৃত চা-পাতিও কাছ থেকে দেখতে পারতাম না। হাতে গোনা চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের বাসায় এই চায়ের আয়োজন মাঝেমধ্যে হতো।

হঠাৎ পিচ্চি পাড়ায় (আমার বয়সীদের মাঝে) গুঞ্জন শুনলাম মিছিলে গেলে নাকি ফ্রিতে চা দিচ্ছে! এই শুনে আমি আমার কাজিনদের সঙ্গে মিটিং করলাম কীভাবে মিছিলে যোগ দেওয়া যায়। অনেক জল্পনাকল্পনা করে শেষ অবধি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম আমরা মিছিল করব। কার মিছিলে যাব এমন কোনো চিন্তা ছিল না, যে চা খাওয়াবে তারটাতেই যাব। একদিন হাঁটতে শুরু করলাম মিছিলের পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে পা আর চলে না। চিল্লাতে চিল্লাতে গলাও অসাড় হয়ে পড়েছে, তবুও এক কাপ চা খাওয়ার জন্য ছুটে চলা।

কতক্ষণ মনে নেই, তবে এতটাই হেঁটেছি যে পা ফুলে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো সেদিন আমাদের ছোটদের চা দেওয়া হলো না। আমরাও চা খাব এই কথাটা কাউকে বলতে পারলাম না। যেন ব্যাপারটা একটা ট্যাবুর মতো! সম্ভবত চায়ের দাম তখন ৫০ বা ২৫ পয়সা। কিনে খেতে পারব, কিন্তু স্টলে গিয়ে বলার সাহস কারও হতো না। সেদিন আশাহত হয়ে ফিরে এলাম।

পরদিন আবার চা-অভিযানে নেমে পড়লাম। আবার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেঁটে চলা, বড় এক স্বপ্ন নিয়ে, চা খাওয়ার স্বপ্ন। সে স্বপ্নে বিভোর হয়ে মিছিলের পেছন পেছন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা, আমার ভাই তোমার ভাই, অমুক ভাইয়ের মার্কা কী, তমুক ছাড়া আবার কী! আবারও মিছিল গোটা ওয়ার্ড ঘুরে গ্রামের খেলার মাঠে চলে আসা। যার মিছিল করছিলাম, সে অর্ডার দিল, সবাইকে চা দিতে বলল। বুঝে উঠতে পারিনি আমাদের এই গণনায় রেখেছে কি না! প্রথম লটে পেলাম না, দ্বিতীয় লটেও না, আশাহত হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ডাকলেন, এই চা খাবি না?

মনে হলো হাজার বছর ধরে এই কথাটা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। হাজার বছর পর কথাটা শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি হাসলাম। সঙ্গে দিল বাটা বিস্কুট! চা দেওয়ার সময় বলল সাবধানে খেতে, অনেক গরম। চা গরম হয় বুঝতাম, কতটা আন্দাজ করতে পারিনি। অনেকক্ষণ বাদে খাওয়া শুরু করলাম, চুমুক দিতেই সুড়ুৎ করে শব্দ হলো! এ যেন এক স্বর্গীয় শব্দ। এই শব্দ এই কিঞ্চিৎ পৃথিবীর হতে পারে না। হতেই পারে না এই অসামান্য শব্দের উৎপত্তিস্থল এই সামান্য পৃথিবী। সেই থেকেই চা-স্বর্গে বসবাস। সে থেকেই চা-এর সঙ্গে চেনাজানা, আত্মীয়তা, পরম আত্মীয়তা।