অস্ট্রেলিয়া ডে: মতের অমত আর অমতের মত

অ্যাডিলেডে আদিবাসীদের উদ্যোগে ইনভেশন ডে পালনের দৃশ্য
অ্যাডিলেডে আদিবাসীদের উদ্যোগে ইনভেশন ডে পালনের দৃশ্য

এই প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত ছবিগুলোর ব্যাখ্যা অনেকভাবে করা যায়। কিন্তু এই লেখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দুভাবে ব্যাখ্যা করার পক্ষে অনেকে মত দেবেন। প্রথমত কালো পোশাক পরিধেয় মানুষগুলো সমবেত হয়েছেন দখলদারি বা Invasion দিবস পালন করার জন্য। অন্যদিকে রংবেরঙের পোশাক পরিহিত মানুষগুলো এসেছেন Australia Day উদ্‌যাপন করার জন্য।

১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি গ্রেট ব্রিটেনের নৌবহর প্রথম সিডনি এসে পৌঁছায় এবং তৎকালীন গভর্নর আর্থার ফিলিপ সেখানে ব্রিটেনের পতাকা উত্তোলন করেন। তখন থেকেই এই দিনটিকে তারা বিক্ষিপ্তভাবে উদ্‌যাপন করে আসছে। কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে এই দিনটি সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা বিশেষ ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য Australian of the Year Award দেওয়া শুরু হয়। সব স্টেট মিলে একইসঙ্গে একই দিনে দিনটি উদ্‌যাপন শুরু করে। এই দিনটিকে আবার স্মরণীয় করে রাখার জন্য Citizenship Ceremony অর্থাৎ নতুন বর্ষে যারা Australian citizenship অর্জন করে তাদেরও আনুষ্ঠানিকভাবে স্মারক তুলে দেওয়া হয়।
শুরু থেকেই এই দিন পালন নিয়ে কমবেশি বিতর্ক চলছে। এই বিতর্ক ১৯৩৮ সাল থেকে সংঘবদ্ধ আকার ধারণ করে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী মানুষদের মধ্যে। তারা এই দিনটাকে invasion day হিসেবে পালন করে থাকে এবং সরকারকে চাপ দিতে থাকে এই দিনটাকে ২৬ জানুয়ারির পরিবর্তে অন্য দিনে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া ডে পালনের দৃশ্য
অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া ডে পালনের দৃশ্য

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য এই দুই গ্রুপের মধ্যে মতের পার্থক্যকে তুলে ধরা নয় বরং একটি বিষয় অবলোকন, জানা ও অনুধাবন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষ একে অপরের মুখোমুখি কীভাবে হচ্ছে সেটাকে তুলে ধরার জন্য।
প্রখ্যাত অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাইদের একটি বক্তব্য তুলে ধরে আমি ওপরের বিষয়টি আরও পরিষ্কার করতে চাই। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিয়ে তিনি বিস্তর লিখেছেন। তার একটি লেখায় তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দ্বন্দ্বটা ব্যাখ্যা করি তাহলে তা নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যা ফিলিস্তিন দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিনে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলে দেখব তারা সংগ্রাম করছে স্বাধীনতার জন্য। একই বিষয় দুই ভাবে মানুষ ব্যাখ্যা করছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এটা কেন হচ্ছে? এর পেছনের মূল কারণ কি? যদি কারণটা জানাই থাকে তাহলে সমাধান হচ্ছে না কেন?
সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অথবা আন্তর্জাতিক গবেষক ও কূটনীতিবিদরা হয়তো পেশি শক্তি, অর্থ, নিজ সুযোগ, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগকে দায়ী করতে পারেন। আমিও তাদের সঙ্গে একমত, কিন্তু এই বিষয়টিকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করলে দুটি বিষয় চলে আসে। একটি শক্তি ও তার ব্যবহার এবং অন্যটি শক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধি।
অনেক দিন আগে বিশিষ্ট লেখক ফরহাদ মজহারের একটি লেখা পড়েছিলাম। যদিও তার অনেক যুক্তির সঙ্গে আমি একমত নই। তারপরও তার একটি যুক্তি বর্তমান সময়ের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন যে দেশে মানুষ রাজনৈতিক মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে একে অন্যকে আঘাত করে সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে আঘাত করাটা অসম্ভব নয়। এই যুক্তির মূলে রয়েছে কিন্তু পেশি শক্তি এবং ওই পেশি শক্তি কীভাবে ব্যবহার হয় তার সামঞ্জস্যতা। যেমন আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ইন্দ্রিয়গুলো তখনই কোনো একটি বিষয়কে সমর্থন করবে যখন আমি দেখব সার্বিক পরিস্থিতি আমার অনুকূলে। বিপরীতটা যে হবে না আমি সেটাকে অস্বীকার করছি না।

অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া ডে পালনের দৃশ্য
অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া ডে পালনের দৃশ্য

বিষয়টি আরেকটু খোলসা করা যাক। একটি দলের মানুষ অন্য দলের মানুষকে তখনই আঘাত করাটাকে শ্রেয় মনে করে, যখন ভাবে তার পেশি শক্তির পেছনে সমর্থন আছে। অর্থাৎ বিষয়টি অনেকটা এ রকম—সবলেরা দুর্বলকে আঘাত করার মতো। কিন্তু এই বলে কি দুর্বলেরা সবলকে আঘাত করবে না? আমি বলব অবশ্যই করবে তবে তাদের বিষয়টি বোঝার প্রক্রিয়া সবলদের চেয়ে ভিন্ন। কেন ভিন্ন, এই প্রশ্নের জবাবের জন্য আমি আমার লেখার শুরুর যুক্তিতে ফিরে যাব।
প্রশ্ন আসতে পারে কেন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এই দিনটিকে মেনে নিচ্ছেন না। অন্যদিকে কেন সরকার এই দিন প্রতিপালন করার জন্য অন্য দিনকে বেছে নিচ্ছে না। আমরা খুব সহজেই মনে করতে পারি, এভাবে দুই গ্রুপ মেনে নিলে বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে। আসলে কিন্তু বিষয়টির সমাধান এখানেই হবে না। আবার বিষয়টি নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হবে।
কারণ প্রত্যেকটা মানুষের জানার প্রক্রিয়া তার প্রতি দিনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যেভাবে প্রভাবিত হয়, ঠিক একইভাবে তার নিজস্ব সত্তা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং আমাদের সব সময় মনে রাখা জরুরি, আমি যেমন অন্যের মতো হতে পারি না, অন্যরাও আমার মতো হতে পারেন না। মাঝখানে যে বিষয়টি খুব জরুরি তা হলো আমার পেশি শক্তির মাধ্যমে অন্যের মানবিক অধিকার এবং অন্যের পেশি শক্তির ব্যবহারের কারণে আমার মানবিক অধিকার যাতে খর্ব না হয়।
যেমনটি আমরা দেখলাম এবারের ২৬ জানুয়ারির বিকেলবেলায়। অ্যাডিলেডে একদল Australia Day পালন করল এবং অন্য গ্রুপ বিরোধিতা করল। একই সঙ্গে একই রাস্তায় ও একই সময়ে। এই দুই গ্রুপের মধ্যে পেশি শক্তির ব্যবহার যে অস্ট্রেলিয়ার অন্য জায়গায় হয়নি আমি তা অস্বীকার করছি না। কিন্তু কেন হলো? তার উত্তর জানার জন্য আপনাকে আবার এই লেখাটা প্রথম থেকে পড়তে হবে।

আব্দুল ওহাব সেতু, পিএইচডি গবেষক, অ্যাডিলেড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>, টুইটার: <@awohab>