মা জননী গর্ভধারিণী

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমার জীবনের শৈশব কৈশোর ও আবাল্যবেলার সবটুকুই কেটেছিল আমার নানু বাড়িতে।

নানাজানের অতি আদর আর ছোট খালামণির ভালোবাসা এই দুটি ছিল আমার মাতৃস্নেহ। তাই মায়ের স্নেহ কি জিনিস না জানলেও কাল্পনিক অনুভূতিতে সেটা হাতড়ে বেড়াই আর খুঁজে খুঁজে ফিরি।
প্রায় আট মাসের গর্ভাবস্থায় এক দ্বিপ্রহরে আমার মা ছোট মামার সঙ্গে নানু বাড়ি এসেছিলেন আমাকে দুনিয়ার মুখ দেখাতে।
নানু বাড়িতে আতুর ঘর নামে একটা ছোট্ট কক্ষ ছিল।
সেই ঘরে অন্যান্য খালাতো-মামাতো ভাইবোনদের মতো আমারও আগমন ঘটে এই পৃথিবীর বুকে।
অক্টোবরের বিশ তারিখে। সে হিসেবে আমি একজন তুলারাশির জাতক।
মায়ের গর্ভে থাকাকালে আমি নাকি খুব নড়াচড়া করতাম। আর থেমে থেমে লাথি মারতাম মার পেটে। শুনে ছোট মামা বলতেন, এবার আমার ভাগনে আসছে। সবল একটা স্ট্রং বেবি হবে।
ভাগনে আমার ফুটবলার হবে। আমিই শেখাব ভালো ফুটবলারের কলাকৌশল। ছোট মামা খুব ভালো একজন সকার খেলোয়াড় ছিলেন সেই কালে।
মা বলতেন পাগল ভাই আমার। আগে থেকেই সব প্ল্যান বানাচ্ছে। কী কী করবে।
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম জেদি আর রগচটা একজন।
কিছু না পেলে জেদে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খেতাম। বাতাসে লাথি ছুড়তাম।
পরে লাথি মারাতে আমি ওস্তাদ বনে গিয়েছিলাম। নানুজানের কাঠের মিটসেফের নেট আমি লাথি মেরে মেরে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।
আর ফুটবল খেলা শেখা তো দূরের কথা। রপ্ত করলাম রাস্তার খেলা। ডাংগুলি খেলায় মত্ত থাকতাম।
আমার মায়ের গড়ন ছিল লম্বা। গায়ের রং ছিল আমার নানাজানের মতো সাদা ধবধবে ফরসা।
গায়ের রং দেখে আমার বাবা মাকে পছন্দ করেছিলেন।
আমি সেই রং মায়ের পেটে থাকতেই আমার ছোট ছোট আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতাম।
দাদা বাড়ির বড় এক গৃহস্থ পরিবারের হাল ধরেছিলেন আমার মা। অনেক লোকজনের জন্য বড় বড় পাতিলে ভাত তরকারি রান্না করতেন।
মায়ের হাতের রান্না ছিল সুস্বাদু। মা কচুশাক আর লাউ ঘন্টের বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
তখনকার দিনে প্রতি ওয়াক্তে রান্নাবান্না করতে হতো। মা যখন হেঁশেলে কেরোসিন তেলের পিদিম জ্বালিয়ে রান্নায় ব্যস্ত থাকতেন, আমি ঘরের বারান্দায় বসে আমার মায়ের ক্লান্ত শ্রান্ত মুখটা দেখতাম। আঁধারে আমি ভয় পেতাম। মা-মা বলে ডেকে উঠতাম।
আমি তখন ঘুমের জন্য উসখুস করতে থাকলে মা বলতেন, দাঁড়াও খোকা, আমি আসছি।
প্রদীপের মিটিমিটি জ্বলা আলো আঁধারে দেখা আমার মায়ের সেই মুখখানি এখনো এসে হাজির হয় আমার এই অতৃপ্ত মনে।
আমার মা শিল্পী ছিলেন। বিশেষ করে সুচিশিল্পে হাত পাকা ছিল।
সেলাই ফোড়ানোর কাজে অনেক পারদর্শী ছিলেন। রুমালে সুচিকর্মে সুন্দর সুন্দর ফুল তুলতেন।
আমার জন্মের পর ছোট ছোট যে কাঁথা লাগবে সেগুলো মা নিজের হাতেই তৈরি করতেন। সে কাঁথাগুলো সাইজে ছিল ছোট ছোট আর দেখতে ছিল খুব সুন্দর। সেগুলো মায়ের পুরোনো রং বেরঙের শাড়ি দিয়ে তৈরি করতেন।
সিল্কের কাপড়ের ওপর আঁকানো ছবির ওপর সুচের কাজ করতেন মা। সেগুলো দেখলে মনে হতো একেবারেই জীবন্ত। খুবই প্রাকৃতিক। জীবন নিয়ে মনীষীদের বলা অনেক উক্তিও সুচের ছোঁয়ায় মা সুতা দিয়ে লিখতেন। সেগুলো কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়েও রাখা হতো।
এমনি একটা উক্তি—‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ আমার নানু বাড়ির দেয়ালে ঝুলানো ছিল বহুদিন।
আরও একটা সুচ সুতায় লেখার কথা মনে পড়ে। লাল সবুজ আর কালো সুতায় লেখাটা ছিল।
‘যাকে ভালোবাস তাকে চোখের আড়াল করো না।’
মায়ের হাতের সুচিকর্ম এবং ফ্রেমে বাঁধানো রঙিন সুই সুতায় লেখা অনেক মূল্যবান উক্তি এখনো আমি যেন দেখতে পাই আমার মানসপটে।
উল দিয়ে বুননের কাজে মার হাত অনেক পাকা ছিল। আমার স্কুল যাওয়ার বয়সে মা আমার জন্য উলের একটা হাফ সোয়েটার বানিয়ে দিয়েছিলেন। এখনো মনে পড়ে ভি-নেকের ওই সোয়েটারটা যে দেখত সেই জিজ্ঞাসা করত কে বানিয়েছে এটা?
সাদা আর কালো রঙের উল দিয়ে বকুল ফুলের ডিজাইন ছিল সেই সোয়েটারে।
মা আমার গুনগুনিয়ে গানও করতেন।
রাতে ঘুমানোর আগে আমার মাথা থাবড়িয়ে কত সব গান শোনাতেন।
‘ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো।’
আবার সেকালের বাংলা ছায়াছবির গানও গুনগুন করে গাইতেন। ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।’ অথবা ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে।’
আমিও তখন রাজকন্যার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়তাম মার কোলে।
আমার মা ছিলেন খুব দিল দরিয়া একজন মানুষ। দান খয়রাত করতেন অকাতরে। দুস্থ গরিব ফকিরেরা মার সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করতেন বিশেষ বিশেষ দিনে।
আমার শিশু শিক্ষার হাতে-খড়িও মায়ের হাতে ছিল।
আমার সাথি বই, ধারাপাত, নামতা সবই শিখতাম মায়ের কাছে।
অক্টোবরের বিশ তারিখ এলে আমি কখনই আমার জন্মদিন পালন করি না।
এটা আমার জন্য খুবই একটা কষ্টের দিন। ওই দিনের বিকেলবেলায় আমার মায়ের প্রসব বেদনা উঠেছিল। আমাকে পৃথিবীর রূপ রস দেখাবে আর গন্ধ শুকাবে বলে।
মা ভীষণ কাতরাতে থাকেন ভূমিষ্ঠ ব্যথায়। পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের ব্যথায় মা আমার নীল বর্ণ ধারণ করেন।
গ্রামের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ধাত্রী রহিমা দাইজান পাশে বসে সাহস জোগাচ্ছিলেন মাকে। তারপর একসময় আমি এলাম ভাঙা বাঁশির সুরে কাঁদতে কাঁদতে। ছোট মামা আর খালামণি খুশি হলেন আমার কান্না শুনে।
ওদিকে মার অবস্থা হলো অনেক খারাপ। কারণ এটা একটা বাধাগ্রস্ত প্রসব অবস্থা ছিল।
গর্ভফুল কোনো অজানা কারণে আটকে থাকল ভেতরে। মায়ের খিঁচুনি শুরু হতে লাগল।
আমার জন্মের পর মায়ের অতিরিক্ত রক্তস্রাবও হতে থাকল। খুবই কমপ্লিকেটেড অবস্থা।
দাইজান অবস্থার অবনতি দেখে গঞ্জ থেকে তাড়াতাড়ি সরকারি ডাক্তার আনার কথা বললে ছোট মামা কাঁদতে কাঁদতে সাইকেল নিয়ে ছোটেন গঞ্জের দিকে।
ডাক্তার এসে দেখলেন আঁতুড় ঘরে রক্তের বন্যা। সেই বন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছেন আমার মা জননী গর্ভধারিণী।
আমি ছিলাম একজন অকালকুষ্মাণ্ড অভাগা অপাঙেক্তয় শিশু। জন্মই ছিল আমার আজন্ম পাপ।
কিন্তু আমার মা তাঁর দেহের বিন্দু বিন্দু রক্তের বিনিময়ে আমাকে এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ ও রং দেখালেন।

*লেখকের ইমেইল: <[email protected]>