মরু জীবন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মালামাল রাখার জন্য একটি ক্যারাভান রাখা হয়েছে মরুভূমিতে। তার পাশেই ছোট একটি তাঁবু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁবুর নিচে শ্রমিকেরা বসে একটু জিরিয়ে নেয়। সামান্য ছায়া পায় ঠিকই, কিন্তু মরুভূমির গরম বাতাস এসে গায়ে লাগে। প্রচণ্ড তাপে গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে যায়। বরফ মেশানো পানিও গরম হতে সময় লাগে না।

মরুভূমিতে পোলট্রি মুরগি পালনের জন্য ছোট একটি ফার্ম হবে। সেই ফার্মের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কয়েকজন শ্রমিক আনা হয়েছে রিয়াদ থেকে। তাদের সঙ্গে হামিমও এসেছে।
চারপাশে খোলা। গায়ে রোদ লাগে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দুই শ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। এখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একটি হাইওয়ে পেট্রল পাম্প। সেই পেট্রল পাম্পের পাশেই বিরাট এক রেস্টুরেন্ট। অন্য পাশে রেস্টহাউস। হাইওয়ের যাত্রীদের জন্য এই ব্যবস্থা।
কাজের জায়গা থেকে একটু দূরে আরও তিনটি ক্যারাভান। সেখানেই শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন দুটি পানির গাড়ি আসে শ্রমিক ক্যারাভানে। একটি চলে যায় সরাসরি ট্যাংকে। অন্যটিতে বোতল ভর্তি খাবার পানি। সারা দিন সেই পানিই ব্যবহার করে সবাই। দুপুর হলে ট্যাংকির পানি খুবই গরম হয়ে যায়। যেন ফুটানো পানি। খাওয়ার পানির জন্য জার ভর্তি বরফ দিয়ে যায় কোম্পানি। সেই বরফটুকুই শ্রমিকদের একমাত্র সম্বল এই মরুভূমিতে।
জুন মাস। মে মাসের শেষের দিকেই রোজা শুরু হয়েছে এ বছর। সৌদি আরব আসার পর থেকে সবগুলো রোজা রাখে হামিম। এ বছরও রোজা রাখবে বলে মনস্থির করেছে।
আজ নয় রোজা। সকাল থেকে গরমের মধ্যে কাজ করছে হামিম। পায়ে সেফটি সু। পরেছে জিনস প্যান্ট ও মোটা কাপড়ের শার্ট। আর মাথায় হেলমেট। মুখও ঢাকা থাকে পাতলা রুমাল দিয়ে। যেন গরম বাতাস এসে মুখ লাগতে না পারে।
সাড়ে ১১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ ছেড়ে দিয়ে অজু করে নেয় হামিম। এক ঘণ্টা ব্রেক টাইম। এর মধ্যে নামাজ আর দুপুরের খাবার। অনেকেই রোজা রাখতে পারেনি এই গরমে। যারা রোজা রাখেনি তারা সময় বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে দুপুরের খাবার শেষ করে। তারপর তাঁবুর নিচে শুয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। কিন্তু গরমে ঘুম আসে না।
কেউ কেউ আবার জামাকাপড় সব ভিজিয়ে রাখে। ভেজা শরীরে গরম বাতাস লেগে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়। রোজার সময় হামিমও তাই করে। পাতলা একটা কাপড় ভিজিয়ে গলার কাছে বেঁধে রাখে। যেন গলা ঠান্ডা থাকে।
আজ তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু রোজা ভাঙবে না হামিম। দেশে থাকতে রোজা-নামাজ ঠিকমতো করা হয়নি। আব্বা-আম্মার কথাও শুনত না। দুই দিনের জীবন। আর হাসিখেলায় সময় নষ্ট করতে চায় না হামিম। ধর্মীয় ওয়াজে বহুবার শুনেছে, পরকালে জীবনের কোনো মৃত্যু নেই। অনন্ত জীবন। সেই জীবনের জন্য খুব ভয় হয় হামিমের। মরে যাবে তবুও রোজা ছাড়বে না। রাসুল (সা.) বলেছেন—‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক।’
দূরে তাকিয়ে আছে হামিম। রোদে পুড়ে মরুভূমির বালু থেকে ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। জলন্ত উনুন নিভে যাওয়ার পর কাঠ কয়লা থেকে যেরকম উড়তে থাকে।
শুয়ে চোখে বন্ধ করে হামিম। দেশের কথা খুব মনে পড়ে। বাড়ির কথা, বাবা-মার কথা। বুকের ভেতরটা ভিজে যায়।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

রোজা রেখেও মাঠে কাজ করতেন আব্বা। আম্মা বলতেন, তুই ঘরে বইয়া কি করস। তোর বাপের লাগে কামে যা। লোকটা রোজা রইছে।
মায়ের কথা শুনত না হামিম। তখন বুঝত না আব্বার কষ্ট। সন্ধ্যার আগে আব্বার মুখটা কাঠ কয়লার মতো কালো হয়ে থাকত। বারবার ঘড়ি দেখত। কখন মাগরিবের আজান হবে।
রোজা রেখেও বাড়ির সব কাজ আম্মা একাই করতেন। দুপুরের রোদের সময় বারবার ঢোক গিলতেন। গলা শুকিয়ে গেলে মানুষ যেভাবে ঢোক গেলে। কিন্তু কোনো দিন তাদের সাহায্য করত না হামিম। কোনো দিন তাদের কষ্ট বোঝেনি।
নিজে কষ্টে না পড়লে অপরের কষ্ট বোঝায় যায় না। চোখে পানি আসে হামিমের। এখন বয়স হয়েছে তাদের, অথচ। তাদের পাশে কেউ নেই। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেয়ে। আব্বার হাঁপানিটা কোন অবস্থায় আছে কে জানে। আম্মার হাঁটুতে ব্যথা। রাতে ছটফট করেন। আবার সকালে উঠে রান্না ঘরে যান।
মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কেঁদে ওঠে হামিম। রোজার মধ্যে একটু দুধ রোজা করে খেতে পারতেন না আম্মা। কদিন পরেই বেতন পাবে হামিম। মায়ের জন্য টাকা পাঠাবে। রোজায় যেন তাদের কোনো কষ্ট না হয়।
রোজার পরে আর একটু বেশি করে কাজ করতে হবে। বিদেশে আসতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ করেছেন আব্বা। ঋণের টাকা এখনো শোধ করা হয়নি। আম্মার একটি গয়না ছিল—দাদাজান দিয়েছিলেন। সেই গয়নাটিও বিক্রি করতে হয়েছিল বিদেশে আসতে গিয়ে। দেশের যাওয়ার সময় আম্মার জন্য গলার হার আর হাতের বালা নিতে হবে। আব্বার জন্য ভালো দেখে পাঞ্জাবির কাপড়।
এ সব চিন্তা করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় হামিম। সেই চিরচেনা গ্রাম। কুমার নদী, সবুজ শস্য খেত। খেতের আল ধরে লম্বা তালগাছ। বাবুই পাখির বাসা। খালের পাশে প্রকাণ্ড শিমুল গাছ। পালতোলা নৌকা। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা। বৈশাখী মেলা...উঠোনের ওপাশে আমলকি গাছে। কাঠবাদাম গাছ। শিউলি ফুল আর রক্তজবা।
করুণ একদলা কষ্ট এসে জমা হয় বুকের ভেতর। সেই আমলকি গাছটি কি এখনো আছে? কেমন আছে আম্মা? কত দিন দেখা হয় না। আম্মাকে হামিম যে এতটা ভালোবাসে, তা বিদেশে না এলে কোনো দিনই বোঝা হতো না।
শব্দ করে কেঁদে ওঠে হামিম। পাশে বসে থাকা পলাশ ওর হাত ধরে বলে, বাড়ির কথা মনে পড়ছে। চল কাজের সময় হয়েছে।
চোখ মুছে দূরে তাকায় হামিম। আবার জলে ভরে যায়। দুপুরের রোদে ভেসে যায় মরুভূমি। তপ্ত বাতাস লেগে শুকিয়ে যায় চোখে পানি। শুধু মনটা ভিজে থাকে অবিরাম।