বাংলা নববর্ষ এবং ছুছুদাই স্নাম থমাই

কম্বোডিয়ায় নববর্ষ উদ্‌যাপনের দৃশ্য
কম্বোডিয়ায় নববর্ষ উদ্‌যাপনের দৃশ্য

পয়লা বৈশাখ বাংলা ভাষাভাষীদের একটি সর্বজনীন লোক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। তবে এখন যেভাবে নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত হয়ে থাকে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো এবং এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজের উপযোগী পঞ্জিকা তৈরি করা। কারণ, প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর ওপরই নির্ভর করতে হতো।

ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

কম্বোডিয়ায় নববর্ষ উদ্‌যাপনের দৃশ্য
কম্বোডিয়ায় নববর্ষ উদ্‌যাপনের দৃশ্য

আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরোনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদারেরা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। এই প্রথাটি এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে।
আধুনিক নববর্ষ উদ্‌যাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ ইরেজি সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পয়লা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পয়লা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন বাংলাদেশে নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় একটা যোগাযোগ আছে। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যান। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ আর নানা ধরনের ভর্তা, শুকনা মরিচ পোড়া, পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরোনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি এক সময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এ রকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন ও আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ঈসা খাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে যার নাম বউমেলা, এটি স্থানীয়ভাবে ‘বটতলার মেলা’ নামেও পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দুর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করেন ভক্তরা। আগেকার দিনে পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরোনো। বদলে যাচ্ছে পুরোনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতী উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। এ রকম নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে বাঙালির প্রাণের ছন্দে দোলায়িত পয়লা বৈশাখ।

কম্বোডিয়ায় নববর্ষ উদ্‌যাপনের দৃশ্য
কম্বোডিয়ায় নববর্ষ উদ্‌যাপনের দৃশ্য

ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সঙ্গে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় গাজন উৎসব উপলক্ষে চড়ক পূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে মন্ত্র পাঠপূর্বক গঙ্গাস্নান করে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এই দিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।
দারুণ অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের বাইরেও ঠিক একই দিনে নববর্ষ পালন করে থাকেন থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারের জনগণ। এ বছর পয়লা বৈশাখ বাংলা বছরের গণনা হতে যাচ্ছে ১৪২৫, পক্ষান্তরে উল্লিখিত দেশগুলোতে নববর্ষের সূচনাতে অর্থাৎ এ বছরের ১৪ এপ্রিল বছর গণনা হবে ২৫৬২। অর্থাৎ গ্রেগরিয়ান বর্ষ গণনা শুরু হওয়ার ৫৪৩ বছর আগে এবং বাংলা বছর গণনা শুরু হওয়ার ১১৩৭ বছর আগে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বছর গণনা শুরু হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবাংলা যেভাবে বর্ষবরণ প্রথা চালু আছে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারে কিন্তু তার ব্যাপক ভিন্নতা লক্ষণীয়।
নববর্ষকে থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’, কম্বোডিয়াতে ‘স্নাম থমাই বা চৌ স্নাম’, লাওসে ‘পি মাই’ এবং মিয়ানমার বা বার্মাতে বলা হয় ‘থিংইয়ান’। কম্বোডিয়াতে শুভ নববর্ষ, তাদের ভাষায় বলে—‘ছুছুদাই স্নাম থমাই’। নববর্ষের সময় এ দেশগুলিতে সরকারি ছুটি তিন থেকে চার দিন হলেও জনগণ প্রায় সপ্তাহকালব্যাপী তা পালন করে থাকেন। এ সময়ে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল’। এই অনুষ্ঠানে থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে এবং কম্বোডিয়ার কিছু কিছু অংশে অতি আনন্দ উৎসাহের সঙ্গে জনগণ একে অপরের ওপর পানি নিক্ষেপ করে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাতির শুঁড়ের সাহায্যে এবং মেশিন দিয়ে পানি স্প্রে করে, নেচে গেয়ে আনন্দ করা হয়। এ ছাড়া আছে বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বেহিসাবি বিয়ার, মদ্য জাতীয় পানীয় গ্রহণের ঐতিহ্য।

সরদার সায়িদ আহমেদ: নমপেন, কম্বোডিয়া।