মা মা-ই

স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে, বা আম কাঁঠালের ছুটিতে যখন দাদু, নানাবাড়ি যেতাম বেড়াতে তখন স্কুল ব্যাগটার ভেতর দিয়ে দেওয়া হতো আম্মুর হাতে তৈরি কাগজের মোটা দিস্তা খাতা আর কাঠের পেনসিল। হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য, থাকত নতুন বইয়ের নিজের হাতে মলাট লাগানো, নতুন বই থেকে কে কতটা কবিতা মুখস্থ করা আর ডিকশনারি থেকে বা ওয়ার্ড বুক থেকে কে কতটা শব্দ মুখস্থ করতে পারি, তার প্রতিযোগিতা আর তার বিনিময়ে মিলত পয়সা বা টাকা।

সেই পাওনা টাকা খরচ করার ব্যাপারেও ছিল বিধিনিষেধ। মাটির ব্যাংকে জমা করার আদেশ থাকত। জমিয়ে জমিয়ে সেগুলো দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো ঢাকা বইমেলায়, এবার তোমরা স্বাধীনভাবে যত পার বই কিনো, আপত্তি নেই। বইমেলার জন্য আমাদের আলাদা বাজেটই করে দিত। এখন পর্যন্ত আম্মুর ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে প্রায় তিন হাজার বই। কিছু আবার চুরিও হয়েছে। অন্য আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, মনের দিক দিয়ে আম্মু আমাদের ঐশ্বর্যময়, আত্মনির্ভর আর প্রবল আত্মসম্মান বোধের দীক্ষাটা ঠিকভাবেই তৈরি করে দিয়েছেন। বইমেলায় বই কেনার আর একটা অন্যতম কারণ ও ছিল অবশ্য। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিল আম্মুর চাচাতো ভাই আর চিত্রশিল্পী সাহাবুদ্দিন নাগরি (যিনি এখন প্যারিস আছেন) খালাতো ভাই। মনে হতো গুরু, শিষ্য, আর চেলার পুনর্মিলনের হাট। তাদের শৈল্পিক বোধ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রগাঢ় জ্ঞানের প্রভাব আম্মুর ওপর কী পরিমাণে ছিল, তা আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর উপলব্ধি পেয়েছি। কারণ আজাদ মামার অনুপ্রেরণাতেই আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং ১৯৭৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো নারীদের ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়, আমাদের আম্মু তখন প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগ দেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনেও নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। যোগ্যতার বলে আম্মুকে বিচার করা হয়নি, কম যোগ্যতার মানুষগুলো নানাভাবে ঠকিয়ে গেছে, আম্মুর কাজকে নিজেদের কাজ বলে চালিয়েছে, আম্মুর সততাকে দুর্বলতা ভেবে নানাভাবে তাঁকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন সহকর্মী থেকে শুরু করে ব্যাংক প্রশাসন। কখনোই কোনো প্রতিবাদ করতে দেখিনি। মনে মনে শুধু নীরবে কষ্ট পেতে দেখেছি। অথচ নিজের ক্ষমতার বলে অনেক কিছুই করতে পারতেন। কখনো আম্মু নিজেকে জাহির করতে দেখিনি, সুযোগ-সুবিধা নিতেও দেখিনি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও অঢেল বিত্তের মধ্যে বেড়ে উঠে ও নিজেকে নিতান্ত সাধারণভাবে রেখেছেন। তবে এটাও বুঝতে পেরে ছিলাম, আম্মুর পুরো জীবনে আমার নানা ভাইয়ের শিক্ষা, আদর্শ, ব্যক্তিত্বের ছায়া কী বিশালভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো রয়েছে আর থাকবে। আলহাজ আবদুল বারী ভুইঞা তৎকালীন সময়ে রামনগর, ভৈরব বাজারে উনাকে চিনতেন না এমন মানুষ খুব কমই ছিলেন। সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে বিশেষ মেহমান হিসেবে ততকালীন পাকিস্তান শাসনামলে আমার নানা ভাইকে তিনবার হজ পালন করতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানকার নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের দেশ ছাড়তে রাজি নন তিনি। দেশপ্রেমের এই গল্প আম্মুর মুখ থেকেই আমাদের শোনা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা কাজিনরা কেউ উনাকে দেখিনি। মা-খালাদের কাছে তাঁর গল্প শুনেই বড় হয়েছি। সে যাই হোক, আম্মুর কাছে আমাদের সাপ্তাহিক, মাসিক কাজের কিছু ফিরিস্তি থাকত। স্কুল ড্রেস, জুতা নিজের হাতে পরিষ্কার করা, দাদু, নানুর সেবা করা, ঘর গোছানো আরও নানান কাজ। ছোটবেলায় যখন দাদুবাড়ি যেতাম, তখন কিন্তু ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খেতাম। দাদু কীভাবে মাটির চুলায় রান্না করত, প্রতিবেশী ফুপুরা কীভাবে চাল করছে, পুকুর থেকে কীভাবে মাছ ধরছে, জমিতে কীভাবে হালচাষ করে, ধান কীভাবে কাটে—এসব প্রাকৃতিক জিনিসের, মাটির স্পর্শে বড় হওয়ার কথা বলতেন আম্মু। কখনো কোনো ড্রেস কিনব বলে টাকা পেয়েছি আম্মুর কাছে ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের পড়াশোনার কাজে লাগবে, তার দাম লাখ হলেও কিনে দিতে কার্পণ্য করেনি। দুই ছেলে কম্পিউটার শিখবে, বাইরে খারাপ ছেলেদের সঙ্গদোষে যেন না পড়ে এ জন্য ১৯৯০ সালে কম্পিউটার এনে দেন বাসায়। তখন কিন্তু এখনকার মতো এত সহজলভ্য আর হাতের নাগালের মধ্যে ছিল না। মাস্টার্সে পড়ার সময়ে বিভূতিভূষণের একটি ছোট চটি বইয়ের দরকার, আম্মুকে বলাতে পরদিন পুরো বিভূতিভূষণ রচনাবলি তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনে এনে দিলেন। কারণ একটাই, বিস্তর জ্ঞান লাভের আশায়। কোনো দিনও আম্মুকে আর ১০ জন বাঙালি মায়েদের মতো অলস দুপুর গল্পগুজব, আড্ডায় সময় কাটাতে দেখিনি। ব্যাংকের চাকরির কঠিন ব্যস্ততার পাশাপাশি বইপড়া, লেখালেখি, নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, অসুস্থ আত্মীয়স্বজনকে দেখতে যাওয়া—এই ছিল আম্মুর চিরায়ত স্বভাবজাত কাজ। একদিন রেগে বলেছিলেন, তুমি সবার সঙ্গে মিশো না কেন? হেসে উত্তরে বললেন, বসে বসে অনর্থক কথা না বলে তো কাজের কাজও করতে পারি। অন্যদের সঙ্গে বসলে তো, ওই শাড়ির দাম, গয়নার দাম, এর-ওর বদনাম, গিবত, নিয়েই কাটাতে হয়। তার চেয়ে নিজের মতো করে থাকাটাই ভালো নয় কি! অবসর সময়ে দেখেছি ঢাকা বৃক্ষমেলা থেকে কিনে আনা অনেক বিরল প্রজাতি এবং বিলুপ্ত প্রজাতির ফল-ফুলের গাছের যত্ন নেওয়া, ভবিষ্যৎ নাতি-নাতনিদের জন্য সবুজে ঘেরা সুন্দর এক ঠিকানা গড়ে দিয়ে যেতে চাই তো সব সময়। দিয়েছেনও কিন্তু আমরা আজ সবাই অনেক দূরে দূরে যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত, সমস্ত দিন। কে, কোথায় পড়ে আছি। আম্মুর শখ বা ইচ্ছে ছিল তাঁর এই বাগানবাড়িতে গিয়ে তাঁর নাতি-নাতনিরা ফলপাকড় খাবে, বাড়ি মাতিয়ে রাখবে, চিৎকার চেঁচামেচি করবে, ছাদে জোছনা দেখার আকুলতা নিয়ে সবাই একসঙ্গে হবে।

আজ আর আমাদের জোছনা দেখা হয় না, গলা জড়িয়ে লালন, রবীন্দ্র গাওয়া হয় না। যাপিত জীবন কত রকম, কত রূপে এসে দেখা দেয়, অনেক অদেখা রূপেও আসে। আজ সত্যিকারভাবে মনের গভীর থেকে অনেক কিছুর উত্তর পেয়ে যাচ্ছি নিজের অজান্তে। আজ তো আমিও দুই সন্তানের মা। সন্তানের মঙ্গলের জন্য একজন মাকে কত রূপেই না দেখতে হয়। মা তো মা-ই। মায়ের কোনো বিকল্প কখনোই হতে পারে না। তাই মাকে নিয়ে কোনো একদিন বিশেষ দিন না হোক, না হোক কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য, বিকিকিনি। মায়ের জন্যই এই জীবন, তাই মাময় হোক আমাদের জীবন। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, সালাম সব মায়েদের জন্য।

*রাওদাতুল জান্নাত, সুইজারল্যান্ড