ফড়িং কি আকাশ ছুঁতে পারে?

ফারিয়া কিছু একটা বলবে কি? এ মনে হয় বলল! অর্ণব অপেক্ষা করে আছে কিছু একটা শুনবে। 

মেয়েটির চোখের ভাষা অচেনা। ঠোঁট জোড়া নড়ছে—এই বুঝি বলে ফেলল।
ফারিয়ার ফরমাশ খাটার জন্য বাধ্য ছেলের মতো তৈরি থাকে অর্ণব। না-খেটে উপায় নেই। পারিবারিক আদেশ বলে কথা।
শপিংয়ে গেলে ব্যাগ হাতে পিছে পিছে হাঁটে। একটু এদিক-ওদিক হলেই ধমক দেয় ফারিয়া। অর্ণবের ভীতিগ্রস্ত অবস্থা দেখে খিল খিল করে হাসে। বান্ধবীর বাসায়, পার্লারে, গায়েহলুদ, বিয়ে ফারিয়া যেখানেই যাবে সঙ্গে থাকে অর্ণব। ফারিয়ার সব সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব তার। উপরি পাওনা হিসেবে ঝাড়ি তো আছেই। মাঝেমধ্যে দুই একটা চড়-থাপ্পড়ও জোটে। অর্ণবকে কড়া শাসনে রাখে। চোখ লাল করে। শুকনো মুখে সবকিছুর কৈফিয়ত দিয়ে যায় ছেলেটা। এতেই মজা পায় ফারিয়া। এভাবে অর্ণবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে নিজের অজান্তেই।

ফারিয়া বাড়িওয়ালার আদুরে মেয়ে। তাদের ভাড়াটের ছেলে অর্ণব। বাবার চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন থেকেই এ বাসায় আছে। সে সুবাদে দুই পরিবারের সম্পর্ক আত্মীয়তার মতো। অর্ণব দুই বছরের ছোট। ফারিয়াকে আপু ডাকে। ফারিয়া যেখানেই যাবে দুই পরিবারই ঠিক করে দিয়েছে সঙ্গে যাবে অর্ণব। মেয়ে মানুষ এক যাওয়া নিরাপদ না। সঙ্গে একজন পুরুষ দরকার। সেটা অর্ণব।

ফারিয়ার অত্যাচারে প্রথম দিকে অতিষ্ঠ হলেও এখন সয়ে গেছে তার। বরং মুহূর্তগুলো ভালোই লাগে। আগে দূরে দূরে থাকার ফন্দি আঁটলেও এখন পাশে ঘুর ঘুর করে।

অর্ণবের প্রতি ফারিয়ার স্নেহ কখনোই প্রকাশ পায় না। কিছু অনুভূতি অর্ণব বুঝে উঠতে পারে না, সেটা ফারিয়ার স্নেহ নাকি ফরমাশ খাটার প্রতিদান। যেমন: আচার বানালে আলাদা করে রাখা। মাঝেমধ্যে পকেটে কিছু টাকাপয়সা ঢুকিয়ে দেওয়া। কথায় কথায় ধমক দিলেও সময়ে-অসময়ে খোঁজ নেওয়া।

ইদানীং কী হয়েছে অর্ণবের! ফারিয়া আপুর প্রতি একধরনের মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায়। ভালো লাগতে শুরু করে। মুখের ভাষায় না হোক; চোখের ভাষায় কোনো প্রশ্রয় আছে কি না, খুঁজতে চেষ্টা করে। ফারিয়ার পছন্দের ফুচকা, চিপস এনে হাতে দেয়। সে উচ্ছ্বসিত হয়ে নিলেও অবাক হয়ে তাকায়। খেতে খেতে বকাঝকা করে। কেন এনেছিস, টাকা পেলি কই এ-জাতীয় হাজারো প্রশ্ন। অর্ণব জানে কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হয়। চুপ করে থাকলেই সব চুকে যায়।

ধীরে ধীরে ফারিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়া, অদৃশ্যতার ছায়া অতিক্রম করতে থাকে। কখনো মনের ইচ্ছায় কখনো অনিচ্ছায় কখনো আনমনে। ফারিয়া কতটুকু বুঝতে পারে জানে না। আদৌ পারে কি না, তা-ও অজানা। সামনে দাঁড়ানোর সাহস তার নেই। ফারিয়ার ব্যক্তিত্বের কাছে স্বাভাবিক আচরণ করতেও ভুলে যায়। কখনো মিনমিনে কখনো মাথা নিচু করে থাকে।

হঠাৎ করেই বিয়ের প্রস্তাব আসে ফারিয়ার। বাসায় বিয়ে নিয়ে সামান্য কথাবার্তা চলতেই অর্ণবের মাথা খারাপ হয়ে উঠে। ফারিয়াকে সে কারও সঙ্গে কল্পনা করতে গিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা খায়।

এত দিনের চলে আসা পথটি হঠাৎই কঠিন অন্ধকার হয়ে আসে। স্বাভাবিক ছন্দটা কেমন বেসুরো হয়ে উঠে। নিজেকে আবিষ্কার করে অন্যভাবে। সে তো আসলেই কেউ নয়। এ পথের যাত্রী সে নয়। কেবল পুকুরে জেগে ওঠা শেওলার মতো। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। শক্ত শিকড় নেই। কিন্তু তার খারাপ লাগছে কেন? সে কি ফারিয়াকে...! না না। সেটা কীভাবে হয়। কিন্তু তার অস্থিরতার মানে কী? চাপা কষ্টের কারণ কী?

গভীরভাবে চিন্তা মগ্ন হয়। বিষয়টি এড়াতে পারে না। বুকে চেপে বসা পাথরটি প্রসারিত হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে। মনের এই উত্তেজনা ও উড়ো উড়োভাবের একটা অর্থ নিশ্চয় আছে।
অসম সম্পর্কের দিকে যাবে, সে সাহস এই জনমে পাবে কি না জানে না। এটা প্রথা বিরোধী। তবু এই প্রথার প্রতি এ মুহূর্তে তার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। এসব চিন্তা তাঁকে উন্মত্ত করে তোলে। খাওয়াদাওয়া থেকে সবকিছুতেই শুরু হয় অনিয়ম। তবে সেই অনিয়ম চেপে রাখার প্রচেষ্টারও কমতি ছিল না।
পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে ফারিয়াকে। তাই পারলারে গেছে সাজতে। ফারিয়া ভেতরে ঢুকেছে বাইরে বসে আছে অর্ণব। পারলার থেকে বের হয়ে অর্ণবের সামনে দাঁড়ায়।
-দেখত কেমন লাগছে আমাকে?
-বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে অর্ণব।
-এই? কী হলো!
-অর্ণব গভীর চোখে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে বলল, দেখতে ঠিক মিস ওয়ার্ল্ড, ফার্স্ট রানারআপের মতো লাগছে।
ফারিয়ার হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কিরে তোর সাহস তো কম না। আমাকে দ্বিতীয় করলি কোন সাহসে।
-না আপু মানে বউ সাজলে না তোমাকে মিস ওয়ার্ল্ড এর মতোই লাগবে।
এবার ফারিয়া চমকে উঠে। এত কিছু জানিস কি করে! অর্ণবের কানে ধরে বলে, পেকে গেছিস না!

পাত্রপক্ষ দেখতে এসে আংটি পরিয়ে দিয়েছে ফারিয়াকে। পাত্রের সঙ্গে কথা বলে সে ঠিক খুশি হতে পারেনি। মনে হয়েছে যান্ত্রিক টাইপের ছেলে-ক্যারিয়ার সচেতন। তার মনের ঠিক বিপরীত। প্রাণচাঞ্চল্য নেই। জ্যোৎস্না রাত, বৃষ্টি, কুয়াশা ভেজা সকাল—এসব ছুঁয়ে যাবে বলে মনে হয় না।
তার ভাবনায় কিছুটা ছেদ পড়ে। উচ্ছলতা হারিয়ে যায়। ছেলেদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি মিশেছে অর্ণবের সঙ্গে। কত যন্ত্রণা দেয় তবু সহজ শান্ত অমায়িক ছেলেটা। অনুভূতিতে অর্ণব পদচারণা করছে আনমনে। ভেবেছে সব ছেলেই এমন।

পরদিন ফারিয়া শপিংয়ে যায়। রিকশায় পাশে বসা অর্ণব। কোনো কথা নেই তার মুখে। ফারিয়া জানতে চায় কি হয়েছে? কোনো জবাব পায় না।
-এই তোর চেহারাটা চোরের মতন লাগছে কেন? চুরি করতে গিয়েছিল নাকি?
অর্ণব কেমন যেন নীরব।

রাস্তার পাশে টং দোকান দেখে নেমে পড়ে দুজন। অর্ণবের চেহারা আজ কেমন যেন দার্শনিক টাইপের। অনেক গম্ভীর। পরিণত হয়ে গেছে একদিনেই ভাবখানা এমন। চা খেতে খেতে বলল,
-আচ্ছা আপু ফড়িং কি আকাশ ছুঁতে পারে?
ফারিয়া একটু চিন্তা করে বলল, নাহ। পারে না। নিজের জীবন যায়। চঞ্চল টাইপ জবাব দেয়।
-গেলে যাবে! চেষ্টা করতে দোষ কী!
-মরার শখ!
-পানসি দিয়ে আমি সমুদ্র পাড়ি দিতে চাই।
-সাহস তো ভালোই দেখাস মুখে। কেন তোকে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে কেন? এই! কি হয়েছে তোর? ভারী ভারী কথা বলছিস ইদানীং!
-আমি একটা পরিবর্তন চাই।
-তুই কি কারও প্রেমে টেমে পড়েছিস নাকি?
-মনে হয় পড়েছি।
-কী...? চোখ লাল করে বলল, কোন বদ মেয়ের ফাঁদে পড়েছিস? এই দে, নম্বর দে। দেখাব মজা।
অর্ণব হেসে বলল, তাকেও মারবে নাকি?
-আগে তোর ঘাড় মটকাব।
চা শেষ করে রিকশায় উঠে। অর্ণবকে একটা টি-শার্ট কিনে দেয়। মনে হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পেয়েছে সে।
সন্ধ্যায় ছাদে উঠে ফারিয়া। আকাশে ভরা জোছনা। সুযোগ বুঝে অর্ণব পিছু নেয়। টি-শার্ট পড়ে ফারিয়াকে দেখায়। নানান কথার মাঝে তার ঘাসফড়িং হওয়ার কথা উঠে আসে।
-আপু ঘাসফড়িং কি এই সুন্দর আকাশটি ছোঁয়ার চেষ্টা করে, না?
-করে হয়তো। উড়তে উড়তে হারিয়ে যায়। আর ফিরে আসে না।
-এমনকি হতে পারে না, দু-একটা পৌঁছে যায়।
-মনে হয় না।
-আপু, দেখো আজ চাঁদটা একটু বেশি সুন্দর?
-হুম। আজ পূর্ণিমা।
-আমার কি মনে হয় জানো? চাইলে চাঁদটাও ছোঁয়া যায়। নিজের করে পাওয়া যায়। সেভাবে চাইতে পারে না বলে চাঁদটা এত দূরে।
-এই! কী বলছিস এসব। তোর এই আকাশ, চাঁদ, সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার রহস্য কী?
অর্ণব চুপসে যায়। এর বেশি কিছু বলার সাহস তার নেই।

ফারিয়া তার বাগদত্তা কেমন জানতে চায়। অর্ণবের মতে, দুনিয়াতে এর চেয়ে খারাপ পাত্র আর দ্বিতীয়টি নেই। তোমাকে সকাল-বিকেল মারবে আপু। বুয়ার কাজ করাবে। এত সুন্দর ড্রেস আর পরতে পারবে না। অর্ণবের কথা শুনে ফারিয়া হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।
-তোর বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে?
অর্ণবের মুখে সারল্যের হাসি।
-তার মানে তুই চাস না বিয়েটা হোক।
-অর্ণব মাথা নাড়ে। হ্যাঁ-না দুদিকেই। কীভাবে বলবে সে! এত কথা কি একসঙ্গে বলা যায়?
-আচ্ছা তোর পছন্দের মেয়েটা দেখতে কেমন?
-ঠিক তোমার মতো।
ফারিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ে। -আমি কেমন?
-তুমি তারাভরা আকাশের মতো সুন্দর।
-হা হা হা! বাহ্! সুন্দর বলেছিস তো। হুমম। ওই মেয়েটির মতো?
-নাহ! মেয়েটি তোমার মতো।
-ছবি দেখা। ফারিয়া একটু ভাবনায় পড়ে। কিছু একটা চিন্তা করে।
-ছবি নাই। তবে আঁকতে পারব।
-গাধা!
-হে হে হে। অর্ণবের মুখে কেবলা মার্কা হাসি।
-প্রপোজ করেছিস?
-সাহসে কুলোচ্ছে না।
-হা হা হা। তুই যেমন আছিস তেমনই থাক। তোর চেঞ্জ হওয়ার দরকার নেই। এটাই তোর সৌন্দর্য।
অর্ণবের অব্যক্ত কথামালা ফারিয়ার মনে স্পর্শ করেছে কি না কে জানে। হয়তো বোঝেও না বোঝার ভান করছে। নয়তো স্নেহান্ধতার আড়ালে অদৃশ্যই রয়ে গেছে।

কাল ফারিয়ার আক্দ। আজ আকদপূর্ব মেহেদি রাত। কাছের কিছু রিলেটিভ এসেছে। অর্ণবকে আর দেখা যাচ্ছে না। সবার আগে থাকার কথা তার। ফারিয়ার কৌতূহলী চোখ খুঁজতে থাকে। মোবাইল বন্ধ পায়। ফেসবুকে অর্ণবের কিছু পোস্ট চোখে পড়ে। আকাশ ছুঁতে পারে অল্প কজন। সে তাদেরই একজন হতে চায়। ফড়িং হয়ে আকাশ ছুঁতে চায়।

মেহেদির শাড়ি ও অর্নামেন্টে অপরূপ লাগছে ফারিয়াকে। তাকে ঘিরে আনন্দ উৎসব চলছে। অর্ণব শেষের দিকে এসেছে কোত্থেকে। দূর থেকে আলগা চোখে দেখছে। ফারিয়ার ইশারা পেয়ে বাধ্য ছেলের মতো কাছে গিয়ে বসে।
-খেয়েছিস ?
-অর্ণব না সূচক মাথা নাড়ে।
-কোথায় গিয়েছিলি? আজকের দিনে কেউ এমন করে?
অর্ণব চুপ করে থাকে। জবাব দেয় না। ফারিয়া আজ বকাঝকা করছে না। কেমন যেন মায়াবী চোখে তাকায়।
প্রায় মাঝরাত। কোলাহল থেমে গেছে। ফারিয়া হাতে মেহেদি নিয়ে বসে আছে একা। অর্ণব কয়েকটা গোলাপ নিয়ে ফারিয়ার সামনে দাঁড়ায়।
-আপু, তুমি কত দিন বকাঝকা কর না। আজ একটু বকে দেবে? তোমার বকাঝকা খুব মিস করি।
ফারিয়া তাকিয়ে থাকে। আজ অন্যদিনের মতো চাঞ্চল্য নেই। স্থির চোখ।

অর্ণবের মনে জমে থাকা অনুভূতি বিস্ফোরিত হয়। প্রণয়ের ঢেউ বাঁধ ভাঙে। ভেতরের অগ্নিকণা উল্কার মতো বেরিয়ে এসে সাহসিক হয়ে ওঠে। ডরভয় কোথায় যেন উবে যায়। এখন সময়টা তার। ফারিয়ার সামনে দাঁড়াতে বিন্দু পরিমাণ সংকোচ নেই। মনে লালন করা স্বপ্ন যখন বড় হয়ে ওঠে অন্য সব ছাপিয়ে। হারানোর ভয় যখন তীব্র হয়ে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন সৌজন্যে ছাপিয়ে বাস্তবতার স্পর্শ পেয়ে যায় অনায়াসে।

কার্যত মনের কথাটি সরাসরি প্রকাশের গতি কাজ করে। ফুলগুলো ফারিয়ার হাতে তুলে দিয়ে চোখে চোখ রাখে। কিছুটা অস্থির কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, আপু, তুমি আমার আকাশ হবে?

ফারিয়ার অপলক দৃষ্টি! কী আছে তাতে? সমুদ্রের মতো গভীর, হিমালয়ের মতো বরফগলা শীতল চোখ।
সহসা অর্ণবের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। অর্ণব গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখের কোনা চিকচিক করছে।
-গাধা! ধরা গলায় বলল ফারিয়া। মুখাবয়বে আরও কিছু বলার অভিব্যক্তি।
অর্ণবের চোখে ফুটে ওঠে আরও কিছু শোনার ব্যাকুলতা।
ফারিয়া কিছু একটা বলবে কি? এই মনে হয় বলল। অর্ণব অপেক্ষা করে আছে কিছু একটা শুনবে।
ফারিয়ার ঠোঁট জোড়া নড়ছে—এই বুঝি বলে ফেলল।
কী বলবে! কী বলবে!

*মোশাররফ হোসাইন রিপন, দুবাই ইউএই