আদিম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সারা দিন পাথরের গায়ে অনর্থক আঁকা বুকি করি। খিদে পেলে পোষা নেকড়ে কুকুরটাকে নিয়ে বনমোরগ ধরতে চলে যাই আমরা কয়েকজন। ভাগ্য ভালো হলে এক-আধটা হরিণও জুটে যেতে পারে। আমাদের মাঝের শক্ত সমর্থ মানুষটার কাঁধে সেটাকে তুলে দিয়ে ফেরার পথ ধরি। শিশু আর বৃদ্ধরা মিলে কাঠ কুটো জড়ো করে রাখে। সেখানে আগুন ধরিয়ে শিকার ঝলসে খাওয়া হয়। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কেউ কেউ গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা হলে বসবে উদ্দাম ঢাকঢোল আর খ্যাপাটে নাচের আসর। ছেলে বুড়ো সবাই নাচব। আমদের চোখেমুখে ঠিকরে পড়বে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার স্বর্গীয় আনন্দ।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের ঝকঝকে আলোয় ছেয়ে যায় চারপাশ। কোনো এক এলোমেলো চুলের আদিম যুবক গান ধরে। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষের জন্য ভালোবাসার গান। বিষণ্ন সুরে বুকের ভেতরটা মুচড়ে যায় পাথুরে গুহার সামনে বসে থাকা হাসিখুশি মেয়েটার। অনেক যত্ন করে সে একমনে মনে হরিণের চামড়া সেলাই করছে। জামাটা তৈরি হলে এক পড়ন্ত বিকেলে এই ভাবুক যুবককে উপহার দেবে। বিস্মিত যুবকের প্রতিক্রিয়া মনের পর্দায় দেখে মনের ভুলে মেয়েটা হেসে ওঠে। ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে গান থামিয়ে দেয়। বুড়ো মোড়লের ইশারায় আবার শুরু হয় গান। এবার সে শিকারের গান ধরে। পাকা শিকারির বর্শার এক ঘায়ে নধর বন মহিষের ছানা কীভাবে কাবু হয়ে গেল তার পৌরুষদীপ্ত সুরেল বর্ণনা। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে।
দূরে কোথাও থেকে জান্তব শব্দ ভেসে আসে। আমাদের স্নায়ু সতর্ক হয়ে যায়। বল্লম, বর্শা আর এঁটেল মাটি দিয়ে বানানো ঢ্যালাগুলো নিয়ে পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে আশ্রয় নেই নারী-পুরুষ সবাই। শিশুদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যায় কয়েকজন বৃদ্ধ। হরিণের চামড়াটা এক বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেই মেয়েটা তীর-ধনুক নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে গান গাওয়া ছেলেটার পাশে। পলকের চোখাচোখিতে ছেলেটার মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ আরও গাঢ় হলো কী? হাতের বল্লম সে আরও শক্ত করে উঁচিয়ে ধরে অজানা শত্রুকে লক্ষ্য করে।
পাশবিক শব্দটা ক্রমশ কাছে চলে আসছে। বুড়ো মোড়লের তীক্ষ্ণ শিষ কানে আসামাত্র আমরা আদিম মানুষেরা এক ধরনের বন্য আদিমতায় ভর দিয়ে ছুটে যেতে থাকি অন্ধকারের দিকে। আমাদের কাছে রাত মানেই যুদ্ধ। আজকে রাতে আমরা সংখ্যায় এক-দুজন কমে যাব। কিন্তু কালকে ঠিকই জন্ম নেবে আরও কয়েকটি শিশু। তাদের মাঝে আমরা বেঁচে থাকব হাজার হাজার বছর ধরে। তাই আমরা ভয় পাই না। কাল রাতেও চাঁদ উঠবে। আমরা হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য বিষণ্ন সুরে গান গাইব। বেঁচে থাকা চলবেই।

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।