একটি নোলকের খোঁজে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দখিনের জানলায় উঁকি দিতেই দেখি অরিত্র হেঁটে যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার রং ছুঁয়ে। একদৌড়ে গিয়ে বললাম—আমাকে ভুলেই গেলি!

বাবা তখন কালীগঞ্জে শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত। মাত্র বদলি হয়ে শিবপুর থেকে ওখানে এসেছেন। সেই সূত্র ধরেই আমি ভর্তি হয়েছি কালীগঞ্জ আরআরএন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে—ক্লাস ফোরে। অরিত্র আর আমি একসঙ্গে মাটি দিয়ে খেলাঘর বানাই, ভেঙে ফেলি, আবার গড়ি। স্কুলে একসঙ্গে যাই। সবুজ ধানের জমিনে প্রজাপতি আর মনফড়িং নিত্য ঘর পাতে আমাদের জন্য। আমরা আয়েশি ঘর সাজাই। রান্নাবাড়ি খেলি, বউ-জামাই সাজি। আমাদের গানে-গজলে সংগত করে রূপনগরের রাখাল বালক রূপায়ণ। আহা! স্কুল পালিয়ে দৌড়ে আসে অনুপম, যূথী, অতসী। কলাপাতায় ভোজন শেষে বৈষ্ণব বাড়ির আম, জাম চুরির নেশায় কয়েকজনের পলায়ন। আমরা ফের ঘর বাঁধি। বাবুই পাখির ঘর। বড়ই সুন্দর। আহা মায়া, কী যে মায়া।

ক্লাস এইটে থাকতে আবার বাবার ট্রান্সফার। এবার আমরা থাকি গাছগাছালি, বুনো লতা আর কিছু নির্মল মানুষদের ছায়াঘেরা এক শীতল পরিবেশে। রংপুরের এক সরকারি কলোনিতে। কলেজ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছি। হঠাৎ রাস্তার ওই পাড়ের বইয়ের দোকানটায় অরিত্রকে দেখে দৌড়ে গেলাম। আচমকা আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল—আমাকে ভুলে থাকতে পারলি? চোখের কোণে মেঘ জমেছে। বললাম, কান পেতে শোন, বুকের ভেতর হু হু কান্না আর ধুকপুকানি কিন্তু তুই! এখনো কি বৃষ্টিতে ভিজে কদম কুড়াস? জ্বর এলেই কেঁপে কেঁপে উঠিস আর মায়ের গলায় জড়িয়ে ধরে বলিস, মা আআআআআ, মিঠিকে একটু ডেকে দাও না!

তিল তিল করে গড়ে ওঠা বাবুই পাখির ওই মায়া ঘরটি ভীষণ টানে আমায়। আমিও যে বুক পাঁজরে ভীষণ যত্ন করে তোকে বেঁধে রাখি। তুই ঘুমিয়ে পড়িস্। দখিনা জানলার উড়ালিয়া গান, জাম পাতায় আলোর নাচন আর পাখিদের সংসারে আমরা করতে শিখি সংসারী যাপন। বুনোফুলের নোলকখানি আহ্লাদী হয়, শিউলির কানফুল আর ঝুমকোজবা ক্রমশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। মুছে যায় পাপ আর গ্লানি। এ এক অনন্ত প্রার্থনা। জীবনের মাছগুলো প্রাণ ফিরে পায়। বাঁশঝাড় ঠিকরে ঝিঁঝিদের বাসর ছুঁয়ে চাঁদমুখে ছিটকে পড়ে কুসুম-আলো। সংসার যাপনের প্রধান উপাখ্যানে আমি নতুন করে রাঁধতে শিখি আলোর পায়েস। প্রেমটুকুই যে আলো...ওই আলোতেই কালো সংস্কার আর প্রাচীন কল্পকথার দুর্ভেদ্য পথে আমি তোর সহযাত্রী হই। নরম আদুরে রুমালে মুছে দিই কপালের ঘাম। হাতে রাখি হাত।

বাবা তখন জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে রাঙামাটিতে কর্মরত। ইউনিভার্সিটির তুমুল মিছিলের দিন শেষে স্থানীয় একটা কলেজে বাংলার টিচার হিসেবে জয়েন করেছি। মিঠেল সকালের নয়া বৃষ্টির ফুরফুরে আমেজ চোখেমুখে ছিটতেই দেখা হলো বন্ধু অনুপমের সঙ্গে। বিস্ময় নিয়ে আমাকে বলল—মিঠি, অরিত্র খুব অসুস্থ, কেমো নিচ্ছে ভেলোর ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমি ‘বনলতা সেন’ পড়তে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাই, শিউরে উঠি...পথের বাঁকে পথ হারিয়ে পেছন পানে হাঁটতে শুরু করি। দূরের বাতিঘরটুকুও অস্পষ্ট ঠেকে। কোথায় যেন আলোর বাড়ি?

সবুজ তাঁতের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে সবুজ টিপ পরা হয় না আর। আটপৌরে ঘটিবাটির যাপিত জীবনও ভারী ঠেকে। আনন্দহীন জীবন, জীবন তো নয়। কুয়াশাঘেরা সকালে পেছনের বারান্দায় এক কাপ চা নিয়ে বসেছি। হাতে পত্রিকার পাতা। অন্যমনস্কতায় ঝাপসা চোখ, অক্ষরগুলোও যেন বিবর্ণ। মনের আলো নিভে গেলে চোখের আলোও ম্লান হয়ে আসে। ম্যাপলগুলো দুঃখভারাক্রান্ত রাতের শরীর বেয়ে কুয়াশা ফোঁড়ে সূর্যস্নানের প্রতীক্ষা করছে...ঝরাপাতাগুলোও এলোমেলো উড়ছে।

ইচ্ছে করছে অরিত্রকে ছুঁয়ে দিই। ঘ্রাণটুকু নেই। ওটাই যে প্রেম। সারা শরীরে মেখে দিই এক মুঠো মাটির গন্ধ। দুজনই ঘাসফুল হয়ে ফুটি। ‘ও মাঝি তোর ডিঙায় জায়গা হইব, আমারে লইয়া যাইবি ওই ফুলপুর সোনাইদিঘির ঘাটে, অনন্ত যাত্রায়!’

বুক পাঁজরে কীসের মোচড়। চিনচিন ব্যথা। আদিম, অকৃত্রিম। না দেখার না সইতে পারার...এমনতর কষ্টবোধ নিয়েও মানুষ বাঁচে। চাপাকান্নায় বুক হিম হয়ে আসে। কখনো পাথর। কান্নার তরজমা করতে গিয়ে আমি আনমনে গাইতে থাকি—

‘শুয়া চান পাখি আমার শুয়া চান পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।’...

একপশলা বৃষ্টি ছিটকে পড়ছে চোখ, মন, বুকজুড়ে। আমি সবুজ জামদানি শাড়ির আঁচল জুড়ে আঁকতে থাকি মেঘের ভোর, ম্যাপল ঝরে যাওয়ার মানচিত্র। বাবুই পাখিটাও ততক্ষণে ফিরে যাচ্ছে আপন ঘরে আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাচ্ছি তিতাস পাড়ের বাউল বাড়িতে—একটি নোলকের খোঁজে!
...

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।