জাপানের আদালতে কিছুক্ষণ

জাপানের ওকিনাওয়ায় নাহা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট প্রাঙ্গণে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে লেখক (সর্ব বামে)
জাপানের ওকিনাওয়ায় নাহা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট প্রাঙ্গণে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে লেখক (সর্ব বামে)

সম্ভবত পুলিশে চাকরি করার কারণেই জাপানে আসার পর থেকেই দেশটির অপরাধ সম্পর্কে আমার জানার কৌতূহল ছিল ব্যাপক। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, গত এক বছরে আমার চোখের সামনে কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হতে দেখিনি। এমনকি এখানে সকালবেলা ও সন্ধ্যায় ট্রেনগুলোতে আমাদের দেশে ঈদের সময় যেরকম ভিড় হয় সেরকম ভিড় হলেও কখনো কাউকে ট্রেনে ওঠা নিয়ে সামান্যতম ধাক্কাধাক্কি করতেও দেখিনি। আর জাপানি ভাষা না জানার কারণে স্থানীয় পত্রিকা পড়া ও টিভি দেখা হয় না। এ কারণে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় জাপানে কোনো অপরাধই নেই। আসলেই কি তাই? অবশ্যই না। জাপানেও অপরাধ আছে এবং সব ধরনের অপরাধই সংঘটিত হয় এখানে। তবে অপরাধের ধরন ও মাত্রা কিছুটা ভিন্ন। আর সংখ্যার দিক বিবেচনা করলে তা মোটেই উদ্বেগজনক নয়। কিছু ইংরেজি নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে জাপানের অপরাধ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। তবে এটা নিশ্চিত, জাপানে অপরাধ করলে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আসতেই হবে। কারণ, এখানে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির সঙ্গে এরা পরিচিতই নয়।

উল্লেখ্য, জাপানে সাজার হার ৯৯ শতাংশের ওপরে। যা নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়।

জাপানের আদালতগুলোতে ফৌজদারি অপরাধের বিচারকার্য কীভাবে পরিচালিত হয় তা দেখার আগ্রহ অনেক দিনের। কয়েক সপ্তাহ আগে শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে আমার অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে জাপানের ওকিনাওয়ায় নাহা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি ফৌজদারি মামলার বিচারকার্য দেখার সুযোগ হয়েছিল। আদালতে ঢুকতেই কঠোর নিরাপত্তা, পরিপাটি পরিবেশ ও সুনসান নীরবতা চোখে পড়ার মতো। আদালত চত্বরে কোনো অবাঞ্ছিত লোকজনের আনাগোনা নেই। নেই কোনো কোলাহল। আদালতের অ্যাটর্নি কেইসুকে ইশি আমাদের বিচার্য মামলাটি সম্পর্কে আগেই প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। মামলাটি ছিল একটি চুরির মামলা। গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে অভিযুক্ত ফ্যামিলি মার্ট নামক একটি কনভিনিয়েন্স স্টোর থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করেছিলেন, যা সিসিটিভিতে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে অভিযুক্তকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারপূর্বক মামলা রুজু করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার পরে ওই দিনই ছিল মামলার বিচারের জন্য প্রথম ধার্য তারিখ। আর প্রথম দিনেই মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে বিচারক বিচারকার্য শেষ করে আসামিকে দুই বছর চার মাসের সাজা প্রদান করেন।

বিচারক আগেই মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে এজলাসে আসেন। প্রথমেই বিচারক আসামিকে জিজ্ঞাসা করে তার নাম–ঠিকানা সঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত হন। এরপর প্রসিকিউটরের বক্তব্য শোনেন। তারপর বিচারক আসামিকে অভিযোগের সত্যতা জিজ্ঞাসা করলে আসামি তার অপরাধ স্বীকার করেন। তবে তিনি বিচারককে বলেছিলেন, ঘটনার সময় তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। এ কারণে সে এটা করেছিল। এরপর বিচারক আসামির আইনজীবীকে তার বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেন। তিনিও আসামির মতো একই বক্তব্য প্রদান করেন। অন্যান্য সাক্ষী এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তার উপস্থিতিও বিচারক প্রয়োজন মনে করেননি। মাত্র ৩০ মিনিটেই বিচার কাজ শেষ করে বিচারক মামলার রায় পাঠ করে শোনান।

বিচারকার্য শেষ হলে অ্যাটর্নি ও কোর্ট স্টাফরা আমাদের মামলার বিস্তারিত ব্রিফ করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আসামি অভ্যাস গতভাবেই অপরাধী। সে এর আগেও একাধিকবার এ ধরনের অপরাধ করে সাজা ভোগ করেছে। তারা আরও জানান, আসামি ক্লেপ্টোম্যানিয়া রোগে আক্রান্ত। আর এ কারণেই সে এ ধরনের অপরাধ করে থাকে।

মামলা রুজুর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে মামলার তদন্তকার্য সম্পন্ন করে প্রথম ধার্য তারিখেই মাত্র আধা ঘণ্টায় বিচার কাজ শেষ করে সাজা প্রদান করা হলেও এটাকে ক্যাঙারু কোর্ট বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কারণ, যে সমাজে মানবাধিকারকে ধর্মীয় অনুশাসনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়, সে সমাজে আর যাই হোক অন্যায়ভাবে কারও শাস্তিভোগের কোনো সুযোগ নেই।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ শুধুমাত্র জনগণের ন্যায় বিচারই নিশ্চিত করে না, বরং জন ভোগান্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও অপচয় হ্রাসেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে।
...

মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ ও শিক্ষার্থী, কিউশু ইউনিভার্সিটি, জাপান।