পুরোনো দিনের কথা মনে এলে ওই দিনটার চিত্র সামনে ভেসে ওঠে। ওই যে আমরা, তা দশজন হব, টিফিন আওয়ারে হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলাম দূরে কোথাও। তা কী সুন্দরদী না কদমপুর পর্যন্ত! আমরা সবাই ছিলাম সে দলের রাজা। ফিরে আসতে দেরি হবে জেনেও আমরা ঘুরেছিলাম। হায় হাতোস্মি! এসে দেখি, এক ধরনের নীরবতা বাইরে। গা ছমছম অনুভূতি আমাদের! ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।
কোন স্যার ক্লাসে ছিলেন খেয়াল নেই। তবে শাস্তিটা হলো মানিক স্যারের হাতে। তিনি তখন বাঘ। সুশীল কুমার কুন্ডু তাঁর কাগুজে নাম। ক্লাসে প্রবেশ নয়, আগে শাস্তি বরণ করতে হলো। চারা কপালে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম দীর্ঘক্ষণ। ওই দিন স্কুল মাঠে এক লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে গেছে। দশ-বারোটি মুখ সেইদিকে। স্কুলের সব শিক্ষার্থীরা বারান্দায় এসে দেখছে দৃশ্যটি। সেই সময় লজ্জায় গুটিয়ে গিয়েছিলাম। তবে আজ রোমাঞ্চিত হই। ভেতরে-ভেতরে হাসি। প্রশ্ন করি নিজেকে। সবারই কী এমন বৈচিত্র্যময় শৈশব ছিল?
এই স্কুল থেকে আমি এসএসসি পাস করি। দীর্ঘদিন পর সেই স্কুলে আমি আজ প্রবেশ করলাম। প্রধান ফটক অতিক্রম করে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে সোজা প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়। হেঁটে বলছি এ জন্য যে, দূর একেবারে কম নয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, ভেতরের মানুষটিকে আমরা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম। মিজানুর রহমান। স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি আমাদের স্বাগত জানালেন।
আমি পরিচয় দিলাম। হাত মেলালাম। লম্বা গড়ন, মুখে দাঁড়ি, পরনে শার্ট-প্যান্ট। আধুনিকতা তাঁর পোশাকে, কথাতেও। এর আগে ছিলেন নগরকান্দা মহেন্দ্রনাথ একাডেমির সহকারী প্রধান শিক্ষক। এই প্রতিষ্ঠানের মতো সেটাও পাইলট স্কুল। বললেন, এখনই ছুটির ঘণ্টা বাজবে। টিচাররা আসবেন কমন রুমে। আপনাদের নিয়ে বসতে পারব।
সেখানে ছিলেন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক প্রভাস বাগচী। তাঁরই ভাই হরপ্রসাদ বাগচী। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলেন। তথ্যপূর্ণ কিছু কথা বললেন সে সম্পর্কে। মিষ্টি এল সামনে। এরই সঙ্গে এলেন আরেকজন অতিথি। তিনি চরযশোরদী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এক প্রধান শিক্ষক এসেছেন আরেক প্রধান শিক্ষকের কাছে। এসেছেন বন্ধুর আলাপ করতে। আমার নিজের এলাকায় আবাস তাঁর। আরেক জেলা কিন্তু দূরে নয়। গল্প হয়, তারপর যাই অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদের ঠিকানা শিক্ষক মিলনায়তন। সেখানকার মিষ্টি গ্রহণ পর্ব তখনো শেষ হয়নি।
ভিন্ন এক পরিবেশ। বিরাট টেবিলের এক প্রান্তে আমি। আমার একদিকে প্রধান শিক্ষক। কথার শুরু তাঁরই মুখে। মনে হলো এমন অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করা তাঁকেই মানায়। নাতিদীর্ঘ বক্তব্য। সেই শব্দচয়ন, প্রক্ষেপণ সেখানে মধুর একটি বাতাবরণ সৃষ্টি করে। তাঁরই উপস্থাপনা গুণে আমি চলে আসি শিক্ষকদের কাছাকাছি।
বলি বিস্ময় নিয়ে, স্কুলের পাশ ঘেঁষে যাই, ইচ্ছে হয় ভেতরে আসি। আবার একটু ভয়ের অনুভূতিও কাজ করে ভেতরে। তারপর সময়ও একটা বিষয়। এর অর্থ, দুই-ই আমাকে পেছনে টান পাড়ে। ঢোক গিলে বলি, আজ সে সব বিলীন হয়ে গেছে। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের রচনার আশ্রয় খুঁজি, আর যেন নেই কোনো ভাবনা...আমি এ আবেশ কভু ফেলে যেতে চাব না!
জহির রায়হানের একটি উপন্যাসে ফাল্গুনে দ্বিগুণ হওয়ার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই শ্রাবণে আজ আমি দ্বিগুণ হলাম। কারণ, সঙ্গে আমার সহধর্মিণী লাকি হালদার উল্কা। সুতরাং কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বাস্তবে তাই হলো। তাঁরা মুখ টিপে হাসলেন। এ হাসি হৃদয়ের। অন্তরের অন্তস্তল দিয়ে তাঁরা আমাকে গ্রহণ করলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, আমরা আপনাদের ভালোবাসায় সিক্ত হলাম।
স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পুরোনো এমন অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। বেয়াল্লিশ বছর আগে এই স্কুল ছেড়েছি। স্কুলটি এর মধ্যে অনেক চড়াই-উতরাই পার করেছে। যারা সেই সময়ে আমার শিক্ষক ছিলেন, কোনো এক কারণে তাঁরা এই স্কুল ছেড়ে চলে যান কিংবা চলে যেতে বাধ্য হন। যোগ দেন প্রতিদ্বন্দ্বী আর এক স্কুলে। আমরা পাস করে বেরোনোর সময় মানিক স্যার হেড মাস্টার। তিনি নতুন জায়গাতেও হেড মাস্টার হলেন। এখন অবশ্য বয়সের হিসেবে তাঁরা সবাই অবসরজীবন যাপন করছেন। এদের মধ্যে একজন পৃথিবী ছেড়ে চলেও গেছেন। আমার সেই শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে।
কয়েকজন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ এখনো অব্যাহত রয়েছে। দেশে গেলে ছুটে যাই তাঁদের কাছে। কারও সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় চলার পথে কিংবা অন্য কোনোখানে। ছাত্র শিক্ষকের এই পরিচয়, এই সম্পর্ক অনেকে মেলাতে পারে না। আমি কী করে আবার ওই স্কুলের স্যারদের ছাত্র হলাম। তাইতো কথা কিংবা গল্পে আমাকে পরিষ্কার করতে হয়, প্রকৃত পক্ষে এঁরাই আমাকে পড়িয়েছেন। বলি, মূলত আমি মুকসুদপুর হাইস্কুলের ছাত্র। এই প্রজন্মের কাছে পটভূমি তুলে ধরতে হয়। তাদের এও জানাই, তখন এই প্রতিষ্ঠানকে নতুন স্কুল বলা হতো।
একটা কথা এই ফাঁকে বলতে ইচ্ছে হয়, আমার স্কুলের প্রতিষ্ঠা কাল ১৯৬৭। তখন রাস্তায় লম্বালম্বি পথে একটি বোর্ডেও তা লেখা ছিল। এই স্কুল একপর্যায়ে মুকসুদপুর পাইলট বালক বিদ্যালয় হয়েছে। এখন দেখি এই স্কুলের জন্ম ১৯৩৮। কেন জানি না।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে এই স্কুলের। আমাদের সময়ে চার পাশ ঘিরে পাঁচিল ছিল না। ছিল না এমন ভবন। বিজ্ঞানের ক্লাস করতে আসতাম খোলা একটি ঘরে। সেখানেই এখন শিক্ষকদের কমন রুম। অনেক পার্থক্য সেই সময় থেকে। জানাই, পরীক্ষার হল থেকে আমাদের এক বন্ধু চম্পট দিয়েছিল। সে কথা সবাইকে তাজ্জব করবে। কোনো এক অপরাধে স্যার তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তিনি রেগে মেগে আনতে গেছেন বেত। মুলি বাঁশের বেড়া খুলে দেওয়া দীর্ঘ হল। সে সময় সেখানে হাতে তালির মতো হাসির ফোয়ারা ছোটে। কী হলো তা আমিও টের পাইনি। স্যার ফিরে দেখেন তাঁর ছাত্রটি নেই। আসলে ওই জানালা নামের খোলা জায়গাটি দিয়ে এক লাফে চলে গেছে সে। আমি হাসির তাৎপর্যটি খুঁজে পাই। আজ পরীক্ষার হল থেকে লাফ দেওয়ার এমন চিন্তা কেউ করবে না বা দেয়াল ঘেরা দালানে সে সুযোগও নেই।
আমাদের সময় স্যারদের পোশাক ছিল পায়জামা-পাঞ্জাবি। জাতীয় সংগীত শেষে ফিরতাম ক্লাসে। স্যারদের বসার ঘর ছিল পূর্বদিকে। আমরা সেখানে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতাম। জাতীয় সংগীত গাইতাম। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজত। আমরা দীর্ঘপথ হেঁটে আসতাম ক্লাসে। এরপর স্যাররাও আসতেন। পাঁচ ক্লাসের পাঁচ শিক্ষক ছুটতেন পাশাপাশি। হাতে তাঁদের চক ডাস্টার। দৃশ্যটি সবার মন কাড়ত।
এখন শিক্ষার্থীদের গায়ে ইউনিফর্ম। তখন ছাত্রদের বিশেষ কোনো পোশাক ছিল না। তবে ওরা এগারো জনের ছিল সাদা পায়জামা আর একই রঙের জামা। তারা অন্য মহকুমা—এখন কার বিন্যাসে ভিন্ন জেলা থেকে পড়তে গিয়েছিল ওখানে। আমি ওই এগারো জনেরই একজন। স্কুলের পথে চলার সময় সবাই চেয়ে থাকত আমাদের দিকে। এরও আছে গল্প, সুযোগ মতো তা নিয়ে আসর বসানো যাবে।
শিক্ষকদের মধ্যে সাখাওয়াত হোসেন স্যার ছিলেন জ্যেষ্ঠ। দেখতাম স্যাররা খুব শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। মানিক স্যার শুরুতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। খেলাধুলা, সংগীত-সংস্কৃতিতে দখল তাঁর। নাটক বা অনুরূপ ক্ষেত্রে তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন। তিনি গিটার বাজাতে পারতেন। সবচেয়ে বড় গুণটি তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা। এ জন্যই বোধ হয় পরবর্তীতে স্কুলে তিনি তাঁর স্থানটি পাকাপোক্ত করে নিতে পেরেছিলেন।
ফটিক চন্দ্র মিত্র। সাহিত্যের শিক্ষক। আজও তাঁর যশ, খ্যাতি ছড়ানো এ জগতে। ইংরেজি-বাংলা দুই-ই পড়াতেন। জানাশোনা তাঁর অনেক। তাইতো তাঁকে তখন বলা হতো ইংরেজির জাহাজ। অন্যদিকে দ্বিজেন কর্মকার পদার্থ বিদ্যা ও জীববিদ্যার ওপর পারদর্শী। দ্বিজেন স্যার প্রচলিত অর্থে বই দেখে পড়াতেন না। শুনতাম, কলেজে স্যাররা এভাবেই ক্লাস নেন। শুরুতে আমরা জীবন চন্দ্র সাহাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাই। তাঁর সম্পর্কে বলতে চান সেই সময়কার এক ছাত্র আবুল হোসেন। তাঁরও আছে অনেক কৃতিত্ব। তিনি এখন এখানকার শিক্ষক। জীবন স্যার সাধারণত ক্লাস নিতেন না। তবে কোনো স্যারের অনুপস্থিতিতে পড়াতে আসতেন। একদিন পড়ালেন ‘মাই এইম ইন লাইফ’। আমি যদিও পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম তবে বলতেই হয়, আমরা ওই দিন অনেকেই ডাক্তার হয়ে উঠেছিলাম। শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে পড়াতেন। পরিষ্কার উচ্চারণ। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও স্যারের ইংরেজি পড়ানোর ধরন আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরবর্তীতে রাজেন্দ্র কলেজে আজিজ হাসান স্যারকে পাই। তিনি পদার্থবিদ্যায় ‘শব্দ’ পড়াতেন। পরবর্তীতে এর ওপর তিনি বইও লিখেছেন। আমাদের সময়ের কৃতি ছাত্র, বন্ধু আজিজুর রহমান পেছনে ফিরে তাকান। মন্তব্য না করে পারেন না, একেবারে জীবন স্যার!
আমাদের গল্প শেষ হয় না। ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা এখন আনন্দ দেয়। বললাম, সহস্র কথার দু-একটি না বললে কী চলে! চলে না। অতৃপ্তি রয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। হয়েও হয় না শেষ।
কথা হয় এক গুণী মানুষ নিয়ে। সরওয়ার জান খান ছিলেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার শীর্ষস্থানীয় একজন। আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিনে তাঁকে নারকেল গাছতলায় একটি বেঞ্চিতে বসা দেখেছি। গায়ে গেঞ্জি, হাতে গামছা। আমার প্রাইমারি শিক্ষক নিয়ে এসেছিলেন আমাকে। বেঞ্চটা গামছা দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বসতে বললেন। শিক্ষকের ইতস্তত ভাব দেখে পরক্ষণে তিনি বললেন, তাহলে ভেতরে যান, দেখুন কেমন চলছে স্কুল। স্যার আমাকে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। সমাজকর্মে সরওয়ার জান ছিলেন নিবেদিত, এ কথা স্যাররা বলতেন। তখন এ সবে মনোযোগ আসেনি। এখন বুঝি, স্কুলের উন্নয়নে তাঁর দান অপরিসীম।
আমাদের নিয়ে স্কুলের মাঠে এলেন রিতা রানি কুণ্ডু। এই স্কুলের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক। সংগীত চর্চা করেন। খোঁজ নিলাম সে সম্পর্কে। তাঁর কন্যা নাচ শেখে। বেড়াতে যেতে বললেন তাঁদের বাড়িতে। মূলত তাঁরা আমাদের আত্মীয়। ভবনের সামনে গাছগাছালির সৌন্দর্য বড় আকর্ষণীয়। স্কুলের পক্ষ থেকে বাগান বিলাস নামে স্মরণিকা বের করা হয়েছে। বুঝলাম, প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনে এমন নামই জুতসই। কথা হলো অজিত কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি খেলাধুলাবিষয়ক শিক্ষক। কবিতা, গল্প লেখেন। নিজের লেখা গান নিজে গেয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ওপর গান গেয়ে তিনি পুরস্কারও পেয়েছেন। ভালো লাগল তাঁকে।
ঘাসের ওপর আসি। কানাই সরকার প্রসঙ্গ আসে। হেড মাস্টার বললেন, বাড়ি এলে ফোন পাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলি। দেখাই সেই জায়গাটি, যেখানে আমরা চারা মাথায় সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে শাস্তি নিচ্ছিলাম। তখন লজ্জায় গুটিসুটি হয়েছিলাম। আজ লজ্জা করেনি। বরং ভেতরে-ভেতরে বিষয়টি উপভোগ করেছি। সময় কম যায়নি। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। শেষতক আমরাও ছুটি নিয়ে দৌড়াই।
নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।