কালো রং ও মেয়ের গল্প

লেখিকা
লেখিকা

হঠাৎ করেই লেখার ইচ্ছের কারণ, বেশ কিছুদিন আগে দেখা একটা সাক্ষাৎকার। যেখানে একজন উপস্থাপিকা কথা বলছিলেন আমাদের তথাকথিত সমাজের মতে দেখতে কালো, কুৎসিত ও খাটো একজন মেয়ে মডেলের সঙ্গে। তাঁর গলি থেকে রাজপথে উঠে আসার গল্প হচ্ছিল।

ঠিক ওই মুহূর্তেই আরেকজনের কথা আমার মনে পড়ল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে আগত নবীনদের জন্য প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে আমি একজন সৌজন্য বিচারকের ভূমিকায় ‍ছিলাম। প্রতিযোগিতায় একটা মেয়ে কালো কাপড়ে কালো মেক আপে একটি নৃত্যনাট্য পরিবেশনা করেছিল। তার পরিবেশনার বিষয়টা ছিল খুবই আকর্ষণীয়—মাতৃগর্ভে থাকা একটা ভ্রূণকে মেয়ে ধারণা করে তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা যখন চলছিল, তখন ভ্রূণটি আর্তচিৎকার করছিল। ভূমিষ্ঠ না হওয়া সেই ভ্রূণটি আকুতি করছিল সবার কাছে তাকে যেন পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয়। সে জন্ম নেবার পর লক্ষ্মী হয়েই থাকবে, সবার কথা শুনবে, এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল। নিঃসন্দেহে অসম্ভব সুন্দর একটি পরিবেশনা ছিল। পরিবেশনা শেষে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এ বিষয়টি তার বেছে নেবার কারণ কী? মেয়েটি জানাল এটা তার নিজের গল্প। সে যখন তার মাতৃগর্ভে ছিল ভ্রূণটিকে মেয়ে ভেবে তার দাদি ও বাড়ির অন্যরা চেষ্টা করেছিল ভ্রূণটি যেন পৃথিবীর আলো না দেখে। শুধু তার মায়ের প্রচণ্ড প্রতিবাদের কারণে মেয়েটি পৃথিবীতে আসে। ধন্যি সেই মা।

সেদিন এতটাই অসার হয়ে গিয়েছিলাম যে, সেআ মেয়েকে বাহবা দিয়ে বলা হয়নি, এ গল্প তোমার একার নয়, আজ থেকে দুই দশক এমনকি এক দশক আগেও যারা জন্ম নিয়েছেন এ রকম গল্প সব মেয়েরই কমবেশি আছে। এখনো আছে অনেক বাড়িতে, মেয়ে পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির ছেলেটিকে পড়াশোনা করানো হয়, কিন্তু মেয়েটিকে নয়। ব্যবহারিক মৌখিক পরীক্ষায় এক ছাত্রী কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, তার জন্মের সময় নাকি তার এক অতি আপনজন মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন মেয়েসন্তান হলে যেন মৃত হয়ে জন্ম নেয়!

এখন আসি নিজের গল্পে। আমাকে দেখার পরে আমার মাকে দেখলে সবাই আশ্চর্য হবেন। আর আমার মাকে দেখার পর আমাকে দেখলে আশাহত হবেন। ছোটবেলায় দেখতাম কেউ বাসায় এলেই বলত আহা মেয়েটা মায়ের গায়ের রং পায়নি, কালো হয়েছে। ছোট মেয়েটা ফরসা হয়েছে ওকে নিয়ে কোনো চিন্তা নাই। এই কথায় মায়ের কীই বা বলার আছে? কিন্তু আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, মায়ের মতো গায়ের রং হয়নি তো কী হয়েছে, মায়ের মতো হুবহু দেখতে তো হয়েছি, তাতে হবে না?

যখন থেকে বুঝতে শিখেছি মানে বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা খুব আহত করত। অপ্রকাশ্য অভিমানের জন্ম নিত অন্তরে। একসময় মনে হতো আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমাকে মানায় না। আর সত্যি কথা বলতে কী দুই দশক আগের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা–মায়েরা তাদের সন্তানদের বুঝতে পারা আর তাদের বন্ধু হতে পারেননি। আমার গায়ের রং নিয়ে হা–হুতাশ করা দেখে নিজেকে একসময় আলাদা করা শুরু করলাম। কোনো অনুষ্ঠানে পরিবারের সবাই গেলে আমি যেতাম না। মনে হতো আমাকে ঠিক মানাবে না, মা–বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে। বাবা–মায়ের অনুরোধ আর বকাঝকা সত্ত্বেও যেতাম না। যাবতীয় সুন্দর পোশাক সবকিছু বোনকে দিয়ে পরির মতো সাজাতাম আর ভাবতাম আমাকে তো মানাবে না। স্কুলের অনেক সুন্দরী সহপাঠীরা নিজেদের হাতের পাশে আমার হাত টেনে বলত, দেখ আমরা কত ফরসা। সাবান দিয়ে স্নান করলে নাকি ফরসা হওয়া যায়। হা–হা–হা–হ–হা।

লেখিকা
লেখিকা

যে বয়সে আমার বিয়ের বয়স হয়নি, তখন থেকেই আত্মীয়স্বজনদের চিন্তা আমার বিয়ে নিয়ে। কেউ একজন অযথা আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন আমার নাকটাও বোঁচা কিনা, আমাকে আমার বাবা বিয়ে দেবেন কীভাবে? একটা মেয়ের জীবনের উদ্দেশ্য যেন শুধু বিয়ে! মজার বিষয় হলো এ কথাগুলো আমাকে কেউ আড়ালে বলত না। সামনাসামনি বলত, আমাকে উদ্দেশ্য করেই। আমি কষ্ট পেলাম কী পেলাম না তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। একবার একজন বলল আমাকে বিয়ে দিতে পাত্রপক্ষ ১০ লাখ টাকা যৌতুক চাইবে। অনেক ছোটবেলাতেই একজনকে বলতে শুনেছিলাম, পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে নাকি আমার ছোট বোনকে লুকিয়ে রাখতে হবে। কতখানি অসম্মানজনক কথা। প্রত্যেকটা মানুষের তো আত্মসম্মান আছে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমরা যে মেয়েদের কত অসম্মান করি তার খবর কেউ রাখে না, রাখার কথাও না।

বছর তিনেক আগে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরেই এক নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন ছোট বোনকে লুকিয়ে রাখার বিষয়টি আবার উঠে এল। এবার জবাব দিলাম, বোনকে আগে দেখতে হবে, বোনকে দেখার পর যদি আমাকে কারও পছন্দ হয় তবেই হবে। কিন্তু প্রিয় পাঠক, উত্তরটা দিতে একটু দেরি হয়ে গেল, তাই না? যখন বুঝতে পারলাম নিজের পায়ের তলার মাটিটা একটু শক্ত, তখনই উত্তরটা দিলাম। শুধুমাত্র এই সমাজে আমার জন্ম বলে কোথাও না কোথাও আমারও মনের ভেতর মেয়ে হিসেবে এই দুর্বলতা ছিল বলে। এখনো অনেকে বলেন, তুমি তো সুন্দর না, বিয়ে আসলে বাছবিচার করো না। তাদের বলা হয়নি, তাদের ভাষায় তথাকথিত বাহ্যিক সৌন্দর্য আমাকে আকর্ষণ করে না, আমাকে বিমোহিত করে না।

আমাদের সমাজে মেয়ে সন্তানের বাবা একটু দুর্বল থাকেন। আলাদা একটা বাড়তি মানসিক চাপ যেন। আমার বাবাও যে ব্যতিক্রম ছিলেন তা বলব না। তবে আমার রাশভারী, গম্ভীর ও রক্ষণশীল শিক্ষক বাবা বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের বন্ধু হতে না পারলেও, জানতেন মেধার মূল্যায়ন করতে, মেধাকে কীভাবে ঝালাই করতে হয়, কীভাবে ধার দিতে হয়। তাইতো আমার পনেরো ষোলো বছর বয়স থেকে যখন আশপাশের আত্মীয়রা মাথা খাচ্ছিলেন বিয়ের জন্য, বাবা গায়ে মাখেননি। আমাকে মানুষ করার সময় একজন মেয়ে হিসেবে মানুষ করেননি। প্রিয় পাঠক, আমাকে আবার অতিরিক্ত মেধাবী ভেবে ভুল করবেন না। অনেক কিছুতেই অনেক কড়াকড়ি থাকলেও শিক্ষা আর জ্ঞান অর্জনের কোনো রাস্তায় আমার বাধা পড়েনি।

প্রকৃতি সুন্দরের পূজারি আমি জানি, সবাই ঈশ্বর প্রদত্ত বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হোক তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যাদের সে বাহ্যিক সৌন্দর্যটা নেই, তাদের অন্তরের সৌন্দর্য প্রমাণ দিতে হয়, তাতে অনেকটা সময় লাগে। ইউরোপে আসার পর অনেকেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন আমি একটু ফরসা হলাম কিনা! আমি রসিকতা করে বলি আগে দেশ ছিল এশিয়া, এখন দেখলে লোকে বলবে আফ্রিকা। গত বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে গেলাম। একটা কথা যেটা আমি এক শ বারেরও বেশি শুনেছি, সেটা হলো আমার তো কোনো পরিবর্তন হয়নি। বলুনতো আমার কী পরিবর্তন হবে? মাথায় কি দুটা শিং গজাবে? বুঝতে পারছেন সবার কি প্রত্যাশা ছিল। আমি কেন মেমসাহেবদের মতো ফরসা হয়ে দেশে ফিরলাম না। অতি নিকট আত্মীয় একজন বলেই ফেললেন, ‘তুমি তো ফরসা হও নাই?’ আমি তো পড়াশোনা করতে বাইরে এসেছি, ফরসা হতে নয়। আমি জানি আপনজনেরা আমাকে ভালোবেসেই আমাকে তাদের মতো করে দেখতে চান, কিন্তু কবে যে আমরা ফরসা কালো এই ঘোরলাগা বাহ্যিক সৌন্দর্য থেকে বের হয়ে আসব। একটা ছেলে কালো হলে সমস্যা নেই, যত দোষ নন্দ ঘোষের!

আমি কালো, আমার বাবার আমাকে অনেক টাকা খরচ করে বিয়ে দিতে হবে—এই কথাগুলো আমার বয়ঃসন্ধিকালের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শুনতে শুনতে আমি বড় হয়েছি। যা মানুষের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এখনতো অনেক বড় হয়ে গেছি, অনেক বুঝতে শিখেছি। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা নয়। তারপরেও আমার কৈশোরে ফেলা ছাপগুলো আমাকে মাঝে মাঝে আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগায়। যে হীনমন্যতায় ওই সময় ভুগতাম, অন্য যেকোনো কারণেও সেই রকম অনুভূতি ফিরে আসে। কিন্তু পরক্ষণে সেই আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। আমার কালো আর মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য আফসোস তো নেইই বরং মাঝে মাঝে গর্বই হয়।

আমাদের মানে মানুষের জীবনগুলোই একেকটা লড়াই। বাংলাদেশের মেয়েদের লড়াই আরও বেশি। লড়াই তাদের সঙ্গে যারা বাইরের সৌন্দর্য দেখে মানুষকে বিবেচনা করেন। বাইরের সৌন্দর্যতো মানুষ জন্মগতভাবে প্রাপ্ত হয়। আর অন্তরের সৌন্দর্য প্রকাশিত হতে সময় লাগে। এ লড়াই তাদের সঙ্গে যারা অন্তরের সৌন্দর্য বিকশিত হওয়ার সময়টা না দিয়েই অনেক কিছু নির্ণয় করে ফেলেন। আমার লড়াই তখন শুরু হয়েছিল যখন আমি জন্ম নিয়েছিলাম একজন মেয়ে হিসেবে। সে লড়াই চলবে আমৃত্যু। আমার লড়াই তখনই শেষ হবে যখন আমি মৃত্যুবরণ করব একজন মানুষ হিসেবে।

আহ শুরুতে বলা হয়নি, আমার এত দূরে আসার অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণা কিন্তু আমার গায়ের রং। আমার জন্ম হয়েছিল একজন মেয়ে হিসেবে, যখন মারা যাব তখন যেন মানুষ হিসেবে মরতে পারি।
...

সুষ্মিতা রানী সাহা: সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটি), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কারদারেলি, ভিতেরবো, ইতালি।