বাংলাদেশের চেতনায় লালিত এক সংগঠন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনার সভার পোস্টার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনার সভার পোস্টার

টরন্টো ফিল্ম ফোরামের আয়োজনে কানাডায় প্রদর্শিত হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনসচেতনতামূলক অনেক বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন জীবনমুখী চলচ্চিত্র। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ আগস্ট ফোরামের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল এক বিশেষ অনুষ্ঠানের। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রয়াত চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ ও চলচ্চিত্রগ্রাহক (সিনেমাটোগ্রাফার) মিশুক মুনীর স্মরণে এক বিশেষ চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনার সভার আয়োজন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন।

মাল্টি কালচারাল চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পোস্টার
মাল্টি কালচারাল চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পোস্টার

ওই দিন সন্ধ্যা ৭টায় টরন্টোর ডেনফোর্থ অ্যাভিনিউয়ের মিজান কমপ্লেক্স অডিটোরিয়ামে তাদের স্মৃতির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে এই অনুষ্ঠানে জাপানের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা নাগিসা ওসিমার স্বাধীন বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র—‘রহমান: দ্য ফাদার অব বেঙ্গল’ ও তারেক মাসুদ পরিচালিত প্রখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের জীবন দর্শনের পটভূমিকায় নির্মিত ‘আদম সুরত’ প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে একটি আলোকিত প্রদীপ মিছিল ও শোভাযাত্রা করা হয়।

আয়োজনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন বাংলাদেশের হাওয়াইন গিটারের অন্যতম পথিকৃৎ এনামুল কবির। তার হৃদয়স্পর্শী সংগীত পরিবেশনা ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সংবলিত স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য সমগ্র অনুষ্ঠানে একটি অনন্য আবহের সৃষ্টি করে। অন্য বক্তারা ছিলেন মিশুক মুনীরের ঘনিষ্ঠ কাজী এ আহমেদ চুন্নু, লেখিকা ও সংগীতশিল্পী ঋতু মীর, চলচ্চিত্রনির্মাতা ফুয়াদ চৌধুরী, ফোরামের সভাপতি ও চলচ্চিত্রনির্মাতা এনায়েত করিম বাবুল। সঞ্চালনার দায়িত্বের ছিলেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও চলচিত্র গবেষক মনিস রফিক।

ফোরামের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা
ফোরামের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা

সীমিত বাজেটে নির্মিত চলচ্চিত্রের যে ধারায় সাধারণত প্রতিফলিত হয় জীবন ও সমাজের বিরাজমান অসংগতির কথা এবং সহজ কথায় কোনো দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ নানা তথ্য, সেটাই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রশিল্পের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কানাডার প্রবাসজীবনের ভিন্ন পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চেতনায় লালিত দেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের স্বাতন্ত্র্য আদর্শ ও ভাবধারাকে অক্ষুণ্ন রাখার প্রত্যাশায় গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে যে সংগঠন নিরলসভাবে কাজ করছে তার নাম টরন্টো ফিল্ম ফোরাম।

এনায়েত করিম ২০১৪ সালে টরন্টোতে আসার পর থেকেই বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিকাশ সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক গবেষণা শুরু করেন। আশির দশক থেকে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনে যাত্রা শুরু হয় মোরশেদুল আলমের ‘আগামী’ দিয়ে। এরপর তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’, ও এনায়েত করিমের ‘চাক্কি’ মুক্তি পায়। এনায়েত করিম অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। টরন্টোতে আসার আগে নিউইয়র্কে টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তার এই অভিপ্রায়কে বিশেষ অনুপ্রাণিত করেছিল।

টরন্টোয় তার চিন্তা ও আদর্শের সঙ্গে যুক্ত হন সমমনা কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ প্রাক্তন সাংস্কৃতিক সংগঠক। তারা হলেন আহমেদ হোসেন, আমিনুল ইসলাম খোকন, জহির রায়হান ফিল্ম সোসাইটির সাবেক সভাপতি সাকিল হান্নান, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী আলোকচিত্রী অপু রোজারিও ও মনিস রফিক।

মুখ ও মুখোশ শিরোনামে অনুষ্ঠানের পোস্টার
মুখ ও মুখোশ শিরোনামে অনুষ্ঠানের পোস্টার

তারা দীর্ঘ মতবিনিময়ের মাধ্যমে টরন্টোতে একটি ফিল্ম ফোরাম গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তাদের সেই সিদ্ধান্ত ও আদর্শের পথ ধরে ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর থেকে যাত্রা শুরু করে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম। টরন্টোর ডেনফোর্থ বাংলাদেশ সেন্টারে প্রতিষ্ঠালগ্নের সেই প্রথম দিনেই ফিল্ম ফোরাম ছয়টি চলচিত্রের সফল প্রদর্শনী করে। সেগুলো হলো এনায়েত করিমের ‘চাক্কি’, আমিনুল ইসলাম খোকনের ‘ফেসিং দ্য ফিউচার’, সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, শাকিল হান্নানের ‘দ্য মিটিং’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবন ডুলি’ এবং মনিস রফিক ও পারভেজ সিদ্দিকীর ‘ব্রোকেন ড্রিম’। এই প্রদর্শনীতে টরন্টোয় অবস্থানরত দেশের বিপুল সিনেমাপ্রেমী দর্শকের সমাগম হয়। সকলের তরফ থেকেই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। প্রথম দিনটিকে চলচ্চিত্র আন্দোলনের এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ খসরুকে উৎসর্গ করা হয়। চলচ্চিত্রে আজীবন তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে দর্শকদের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক আর্থিক সহায়তা ও একটি ক্যামেরা উপহার দেওয়া হয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতি মাসেই নিয়মিতভাবে এই ফোরাম প্রবাসে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শিল্পের প্রসার ও সম্প্রসারণ বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনা আয়োজনের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক প্রকাশনা করে আসছে। একই সঙ্গে টরন্টোয় আমন্ত্রিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সম্মানে তারা বিভিন্ন সময় নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। ফোরাম ২০১৭ সালের নভেম্বরে একুশজন সদস্যের সমন্বয়ে তাদের দ্বিতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করে। সিনেমা অনুরাগী গুণীজনদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশে ও প্রবাসে মানুষের বাস্তবধর্মী নানা দিকের প্রতিফলন ঘটাতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কার্যনির্বাহী এই কমিটিতে আছেন এনায়েত করিম, আমিনুল ইসলাম খোকন, আহমেদ হোসেন, মনিস রফিক, সাইদুল আলম টুকু, জগলুল আজিম রানা, শাকিল হান্নান, লরেন্স অপু রোজারিও, দেলওয়ার এলাহী, বিদ্যুৎ সরকার, রাজিনা রহমান, সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল, রেজা অনিরুদ্ধ, সোলাইমান তালুত রবিন, নাদিম ইকবাল, আসগার কাজী, রাফি লোটন, দেলোয়ার হোসেন দুলাল, শেখ শাহনেওয়াজ, হিমাদ্রি রায় ও সাবিনা বারী লাকি।

সাধারণ সদস্যরা হলেন ফাইয়াজ নূর, হাবিবউল্লাহ তরী, রিয়াজ মাহমুদ, আরিফ ভূঁইয়া, শাকিল উদ্দিন, গৌতম সিকদার, মুক্তি প্রসাদ, হোসনে আরা আক্তার হাসনা ও কুমার অনুপ। পাঁচজন উপদেষ্টা হলেন ফুয়াদ চৌধুরী, ইকবাল করিম হাসনু, এম আর জাহাঙ্গীর, সায়েদ আবদুল গফফার ও মোহাম্মদ আমিন মিঞা।

কানাডার ১৫০ বছর উপলক্ষে ২০১৭ সালে ফিল্ম ফোরাম আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
কানাডার ১৫০ বছর উপলক্ষে ২০১৭ সালে ফিল্ম ফোরাম আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল

২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর টরন্টো ফিল্ম ফোরাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তিতে দিনব্যাপী এক আনুষ্ঠানিক আয়োজনে অতিথি হিসেবে সম্মানিত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী লিয়ার লেভিনকে। যিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সরাসরি ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। পরিচালক তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ঐতিহাসিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’ সিনেমাটি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছিল লিয়ার লেভিনের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালের ধারণকৃত বিভিন্ন ফুটেজ থেকে।

গত তিন বছরের অগ্রযাত্রায় ফিল্ম ফোরামের বহুমুখী আয়োজনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে অসংখ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সংগীতসন্ধ্যা ও গুণীজন সম্মাননায়। কানাডার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বহুমাত্রিক সংস্কৃতির সহনশীলতার দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে কানাডার ১৫০ বছর উপলক্ষে ২০১৭ সালে ফিল্ম ফোরাম আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এই আয়োজনে ১৩টি ভাষার ২৮টি ফিল্ম প্রদর্শিত হয়।

ফোরামের অনুষ্ঠানে সদস্যরা
ফোরামের অনুষ্ঠানে সদস্যরা

শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই নয়, একই সঙ্গে ফিল্ম ফোরাম আর্তমানবতার সেবায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষেদের জন্য টরন্টোর অধিবাসীদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক তহবিল সংগ্রহ করে সমাজকল্যাণেও ভূমিকা রেখেছে। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার সমাপ্তিতে মুক্তচিন্তার শিল্পানুরাগী আলোকিত মানুষগুলো মিলিত হন মিজান কমপ্লেক্সের ফিল্ম ফোরামের অফিসে। সেখানে আলোচনা চলে ভবিষ্যতে কীভাবে ফোরাম মানব কল্যাণে নতুন আঙ্গিকে পরিচালিত হবে। কী প্রক্রিয়ায় প্রবাসে সমমানের চিত্র পরিচালকেরদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হবে। অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রয়োজনীয় অর্থ কীভাবে সংগৃহীত হবে এবং প্রদর্শনী আয়োজনের সমস্যা ও সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে।

ফোরামের অনুষ্ঠানে সদস্যরা
ফোরামের অনুষ্ঠানে সদস্যরা

কানাডার জীবনের ভিন্নধর্মী বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে দেশীয় চলচ্চিত্র আবহে শিল্পের মাধ্যমে জীবনের কথা, সমাজের মানুষের কথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তচিন্তার, মানবতার শুদ্ধ প্রত্যয়ে লালিত আলোকিত সংগঠন টরন্টো ফিল্ম ফোরামের এই পথ যাত্রা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ফোরামের সকলের আগামীর অগ্রযাত্রায় রইল আমার অফুরান শুভকামনা।
...

ফারজানা নাজ শম্পা: হালিফ্যাক্স, কানাডা।