ভয়হীন স্বাধীন বিকাশের সুযোগ

ওভাল স্টেডিয়ামের পাশে সবুজ চত্বর
ওভাল স্টেডিয়ামের পাশে সবুজ চত্বর

বছর তিনেক আগে ছিলাম মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। বৃষ্টির নগরী কুয়ালালামপুর। আলো ও জল মিলে সব সময় এ শহর থাকে সতেজ। পাহাড় ও বহুমুখী রাস্তা এ শহরকে দিয়েছে বাড়তি নান্দনিকতা। রাস্তাঘাট ছিল একেবারেই অনন্য। রাস্তা দেখতে অনেকটা প্যারিস নগরীর মতো। আছে সুউচ্চ অট্টালিকা। যে শূন্যতা সেখানে আছে তা হচ্ছে নেই কোনো নদী। যেখানে রাত ও দিনের পার্থক্য বোঝা কঠিন। রাতের আকাশ থাকে বাতির আলোয় লাল।

এখন আমি যেখানে বাস করি তার নাম অ্যাডিলেড। ছায়া সুনিবিড় শান্ত শহর। অ্যাডিলেড ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী শহর। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। এখানে ঘুম ভাঙে সকালবেলা পাখির ডাকে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মন চলে যায় বাংলাদেশের গ্রামে। সকালবেলার সূর্য নিয়ন বাতির মতো মনে হয়। আলো অনেকটা আদুরে ধরনের। দুরে গেলে লাগবে শীত। আবার শরীরে লাগলে গরম অনুভাব হয়। দিনটা থাকে অনেক বড়। আলোর তীব্রতা কমার শেষে নেমে আসে নীরবতা। কিন্তু তখনই কোলাহলময় হয়ে ওঠে পানশালা। দেখা যায় বাতির আলোয় জ্বলে ওঠা ফরসা রমণীর প্রমোদ মেলা।

রাতের বেলায় তৈরি হয় ভুতুড়ে পরিবেশ। পরিবেশটা শুধুমাত্র ভুতুড়ে না, অনেকে দেখেছে ভূত। লোকজন এখানে রাতের খাবার শেষ করে সন্ধ্যার পরে। জোছনা রাতের আকাশ বড়ই সুন্দর। চাঁদটা যখন গোল হয় তখন চাঁদকে বেশ কাছে মনে হয়। রাতের গভীরতায় জীবনকে অনুভব করা যায় ভালো। যেদিকে তাকায় সেইদিকেই গাছপালা। শীতকালে যে গাছপালা পাতাশূন্য হয়েছিল তা এখন সবুজ পাতায় পরিপূর্ণ হচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির আধুনিকতা।

মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে লেকের মতো ছোট নদী, সুদীর্ঘ রাস্তা, ছোট বড় অট্টালিকা। আর নানা ধর্মের উপাসনালয় দেখা যায় এ শহরে। আছে শত বছরের পুরোনো মসজিদ। নদীতে দেখা যায় পাখি ও হাঁস। একটু একটু করে তারা খায় ও বিশ্রাম নেয়। নদীর দুই ধারে আছে সাইকেলের রাস্তা। সাইকেলে এদের প্রিয় যানবাহন। ছুটির দিনে সবাই বের হয়ে যায়। যে হয়তো কথাই বলতে পারে না ভালো সেও বের হবে সাইকেল নিয়ে।

সপ্তাহব্যাপী সবাই থাকে বেশ ব্যস্ত। শুক্রবার সপ্তাহের শেষদিন। কারণ এদিনে সবাই পছন্দসই ভাবে পার করতে চায় সময়। শহরতলির কেন্দ্রে আছে ভিক্টোরিয়া স্কয়ার। শহরতলি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে খেলার মাঠ, পার্ক, জাদুঘর ও মার্কেটের মাধ্যমে। শহরতলির শপিং ও বিনোদনের জায়গার নাম রোন্ডল মল। সেখানে দেখা যায় সাধক মানুষ। পিয়ানো ও সংগীত তাদের সাধনার বিষয়।

শহরে যানবাহন আছে তিন ধরনের। বাস, ট্রাম আর ট্যাক্সি। মোটের ওপর জনসংখ্যা কম থাকায় বাহনগুলো থাকে ফাঁকা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার শহরতলির মধ্যে আছে গ্রামের আভা। এখানে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পশু-পাখি দারুণ সাহসী। মনুষ্য জীব অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। নিজেরা নিয়মের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। সবাই আত্মনির্ভরশীল। নিজের কাজ সবাই নিজে করে।

এখানে এখন বসন্তকাল। আমার কাছে অনেকটা শীতের মতোই মনে হচ্ছে। পরিবর্তনটা বোঝা যায় এখানের গাছপালার দিকে তাকালেই। সবখানেই ফুটেছে নানারকম ফুল। বাড়িগুলোতে ফুটেছে সাদা ও লাল গোলাপ। তবে বাড়িগুলোর দেখতে আমেদের দেশের মতো নয়। সাধারণ, কিন্তু ছবির মতো। এক পাশে পাহাড় অন্যদিকে সমুদ্র। আর আছে অসীম নীল আকাশ। মহাসাগরের তীরে গেলে দেখা যায় আকাশের নীল রং ও সাগরের নীল জল মিলে একাকার হয়ে গেছে।

মাইন্ট লফটি
মাইন্ট লফটি

এখানে মাছের মূল উৎস হচ্ছে এই মহাসাগরগুলো। রক্তিম সূর্য যখন হেলে পড়ে তখন সাহেব বাবু রূপী জেলেরা তীরে ফিরে আসেন। সাগরের তীরে পাঁচ তারকা হোটেল। কাছে গেলে বোঝা যায় মানুষের বিলাসী জীবন। এখানে সহসায় চোখে পড়ে ডলফিন। আরও দেখা যায় দূরে দাঁড়ানো জাহাজ। কিন্তু লোকজনের সমাগম এত বেশি না। গরমের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সাগরে ভিড় বাড়ছে নানা বয়সী মানুষের। আছে নাগরিক জীবনের নানান সুযোগ-সুবিধা। মানুষের চেহারায় নেই কোনো উৎকণ্ঠা।

শহরটিতে আছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। দ্য ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড এর মধ্যে সব থেকে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এই ক্যাম্পাসের ছাত্র আমি। যে ভবনে বসি তার নাম বার্গস (Braggs) ভবন। আমার ডানদিকে বসে চাইনিজ আর বামদিকে বসে কানাডিয়ান। এখানে সবাই সবার সবার নাম ধরে ডাকে। এভাবে নাম ধরে ডাকার ব্যাপারটা কেন হয়েছে তা নাই জানা আমার।

এখানে আছে তরুণ তরুণীর স্বাধীন বিকাশের সুযোগ। বিকাশের সুযোগ আছে বলেই দ্য ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড সৃষ্টি করতে পেরেছে পাঁচজন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীর। ভয়হীনতাই বিকাশের অন্যতম কারণ। তরুণেরা বেড়ে উঠছে সাহসিকতা নিয়ে। মোটকথা দুটি নগরী আধুনিক বিশ্বের ছায়াছবি, যেখানে জীবন অনুভবের সুযোগ আছে। সুযোগ আছে নিজকে মেলে ধরবার।