বেলেশ্বর পল্লি

বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস
বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস

বেলেশ্বর পল্লি। ওখানে কী বেলপাতা দিয়ে ঈশ্বরের পূজা করা হয়? নাকি ঈশ্বর ওখানে বাস করেন বলেই এমন নাম! আমার মনে হয় এ গ্রামের মানুষগুলোই ঈশ্বর। আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করে ছোটরা।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে এক জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছিল একটি গ্রামকে। বলা হয়েছিল, ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে। সে গ্রামে বিত্তবান লোকেরা বাস করতেন। তাদের প্রভাব ছিল। তারা দিনকে রাত কিংবা রাতকে দিন করতে পারতেন। কিন্তু এ গ্রামের মানুষ তেমনটি নন। তারা গ্রামে কেউ এলে খবর নেন। তাকে দেখতে আসেন। নারী-পুরুষদের সে ভিড়ে থাকে শিশু-কিশোরেরা। ওই যে বললাম, ওরাই রাজা। ওরা গানের আসরে গলা ছেড়ে হৃদয়ের আকুতি ঢেলে দেয়। ‘রূপালী সংঘ’ ওদের ঠিকানা।

বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস
বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস

চৈতি দাস। দ্বাদশ বর্ষের শিক্ষার্থী। মধুখালী আইনউদ্দিন কলেজে পড়ে। ওর আকাশটি অনেক বড়। সুনীল আকাশ নিয়ে গান গাইল। শুনলাম আমরা। মুগ্ধ হলাম। পরে কথা হয়েছিল ওর সঙ্গে। সকাল-সন্ধ্যায় গান।

অনুশীলন করে বাড়িতে। বলল, সে সময় মা থাকে তার পাশে।

রাব্বি গান ধরল। লোকগীতি। ‘চল যাই আজিমিরি খাজার দরবারে কৃপা নিতে...।’ আকাশ বাতাস একসঙ্গে দ্যোতনা তোলে। বুঝলাম আনন্দের কাল এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা এ সুযোগ ষোলো আনা ব্যবহার করব।

এখানে আমি একা নই। এসেছেন লাকি হালদার উল্কা। রূপালী সংঘের শিল্পকলা বিষয়ক কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ ভট্টাচার্য। আহ্বান ছিল, তারই ক্লাস দেখার। সেখানে আছেন চঞ্চল হালদার। এ ক্ষেত্রে উচ্চাঙ্গ সংগীত তার শাখা। আমাদের সঙ্গী ছিলেন তৃপ্তি হালদার আর রনজ হালদার। আমরা দেখলাম, ওদের অনুশীলন চলছে।

বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস
বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস

অর্পিতা দাস গেয়ে ওঠে—‘ভুলে গেছি জীবনের ক্রন্দন/ দিকে দিকে পড়ে গেল সারা।’ অপূর্ব নির্বাচন। আঁটসাঁট হয়ে বসি। জানলাম, এক বছর ধরে শিখছে। রামকান্তপুর থেকে আসে সে। মূলত শ্রীনাথপুর, গাজনা নিয়েই এই এলাকা। ওই যে পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের কবিতা! গাজনার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করিতাম দেরি...। সেই পুণ্য ভূমিতে আমরা এখন।

অরিত্রা বিশ্বাস ডাক দেয়। তোরা আয় আয় আমার ভাই/ চল চল বৃন্দাবনে যাই। চমৎকার করেই গাইছে কিশোরী। আজ তবলায় অতিথি শিল্পী। সজল হালদার আবুধাবিতে ছিলেন। ফিরেছেন নিজ দেশে। বাজনায় ধূন তুলছেন তার নিজস্ব ধারায়। গানের জগতের মানুষ। চুপ থাকার কী আর কায়দা আছে!

রূপালী সংঘের শহীদ মিনারের কয়েকজন শিক্ষার্থী
রূপালী সংঘের শহীদ মিনারের কয়েকজন শিক্ষার্থী

সাদিয়া আফরোজ পালা ঘুরিয়ে দিল। সে এল রবীন্দ্র ভবনে। মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে...। শিক্ষক পাশে বসা। যেখানে যতটুকু ধরার বা বলার বলেন। ষষ্ঠ শ্রেণির এই কিশোরী বলল, লেখাপড়া ও গান—দুই-ই ভালো লাগে।

এদিকে গিটার হাতে পাপ্পু। সুরে তালে গানকে নিয়ে যাচ্ছে আরও ওপরে। দ্বাদশ বিজ্ঞান পাস করল এবার। মধুখালীর আইনউদ্দিন কলেজ থেকে। দেখলাম, সুরের ঐকতান গড়ে তুলছেন তারা। সম্মিলন ঘটাচ্ছেন সংগীত কলার বিভিন্ন শাখার। ঘটছে বিভিন্ন যন্ত্রের সমাহার।

বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস
বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস

সরস্বতী পাল করল লোকগীতি। ‘হাউস করে দিছে বিয়ে পাঁচ ভাইয়ের সংসারে। ভাশুর-শ্বশুর জাতকুল মান গেল, হাড়গোড় ভাঙিয়া গেল দেওরারে!’ তার দাদা নিয়ে যত কথা! বলল প্রাণ খুলে। হ্যাঁ, অবশ্যই সুরে তালে লয়ে। এই গান তার প্রিয় গান। হাইস্কুলের ছাত্রী। জিজ্ঞেস করি, এ গানের অর্থ জান তো! ও মাথা নিচু করে হাসল।

এবার কর্মাধ্যক্ষের পালা। সবাইকে কাছে ডাকেন। ঘন হয়ে বসতে বলেন। সমবেত কণ্ঠে গেয়ে যান। ‘ময়ূরপঙ্খী নায়, কোন্ মিস্ত্রি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়! আধ্যাত্মিক গান।

প্রদীপ ভট্টাচার্য রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র ছিলেন। ফরিদপুর শিল্পকলার সঙ্গেও ছিলেন ওই সময়। মঞ্চ নাটক করেছেন, গান গেয়েছেন। শিল্পকলা নিয়েই তাঁর চর্চা। তার সহকর্মী চঞ্চল হালদার বলেন, এই অনুশীলন কেন্দ্রের সঙ্গে আছেন আনন্দ দেবনাথ। নৈহাটী, ভারত থেকে গান শিখেছেন তিনি। বিশেষ বিশেষ সময় আসেন এখানে।

বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস
বেলেশ্বর পল্লির রূপালী সংঘে গানের ক্লাস

কর্মাধ্যক্ষ বলেন, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি রূপালী সংঘের যাত্রা। তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম এই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। গল্পের ঢঙে তিনি বলেন, জমকালো একটি আয়োজন! উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নির্মাণ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছিল ইফতেখার আজম নিলুর হাতে। তিনিই রূপালী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আরও বলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবদুল জব্বার, আবদুল হাদী, বশীর আহমেদ, শাম্মী আখতার এসেছিলেন। টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছিল। পরে সংসদ সদস্য মাহমুদুন্নবী দিলেন টাকা। মাহমুদুন্নবী উচ্চবিদ্যালয় তাঁরই নামে। সবাই উপভোগ করলেন অনুষ্ঠান।

রূপালী সংঘের আছে খেলাধুলার নিজস্ব মাঠ। আছে মার্কেট—যা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দ্বিতল ভবনের ওপরে পাঠাগার হচ্ছে, জানালেন তিনি। এর সঙ্গে যুক্ত এখন শিল্পকলা। এ শাখা আড়াই বছর আগে শুরু করা হয়েছে। শিশু-কিশোররা শিখছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮।

সবুজ পল্লি। মেহগনি আর বনজ গাছের ডালে ঘেরা। আম জাম কাঁঠাল বাগানের মাঝে বসে আছে এর বাড়িগুলো। মানুষগুলোর তেমন খেদ নেই। চাওয়া পাওয়া সামান্য। পাখির কলতান এলাকাটিকে স্বর্গ বানিয়েছে। তারা এদের ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার এদের ডাকেই ওঠে। গানে ঘুম, ঘুম থেকে ওঠাও গানে। এখানে ঈশ্বরের সন্তানেরা সংগীত শিল্পকলায় কিছু একটা করছে। তবে দুনিয়া কাঁপাবে তখনই, যখন এই খুদে শিল্পীরা বড় হবে।
...

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইমেইল: <[email protected]>