সিডনির টিউলিপ মেলায় একদিন

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

সিডনির বওরাল সাবার্বের করবেট গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মৌসুমি টিউলিপ মেলা। শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে। চলবে ১ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতিবছরের মতো এবারও বহু প্রজাতির টিউলিপের সমন্বয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে পুরো করবেট গার্ডেন। করবেট গার্ডেনের সর্বমোট ১৩টি বেডে বিভিন্ন রঙের টিউলিপ লাগানো হয়েছে। সেগুলোর প্রায়ই সবই ইতিমধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বাকিগুলোও কিছুদিনের মধ্যেই ফুটবে। এ ছাড়া করবেট গার্ডেনে রয়েছে কিছু লক্ষণীয় গাছ। এর মধ্যে ১৩টি গাছকে টিউলিপ মেলায় সরবরাহ করা লিফলেটে বিশেষভাবে দেখানো হয়েছে এই গাছগুলোর বিশেষত্বের কারণে।

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

আমার কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় গাছ মনে হয়েছে জাপানিজ ক্রাব আপেলের গাছটিকে। এই গাছে কোনো পাতার চিহ্ন নেই বললেই চলে। সারা গাছের সমস্ত ডালপালা ফুলের ভারে নুয়ে পড়ছে। শুভ্র সাদা ফুলে ছেয়ে আছে সারা গাছ। আর মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। আপনি যদি সামান্য সময়ের জন্যও এই গাছের নিচে দাঁড়ান তাহলে মৌমাছির গুঞ্জন শুনতে পাবেন। এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ করে রাখা দরকার, করবেট গার্ডেনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার নাকে এসে লাগবে মধুর সুগন্ধ। আমরা দোকান থেকে যে মধু কিনে আনি ঠিক তেমনই একটা সূক্ষ্ম গন্ধ। এ ছাড়া একটা ঝাউ গাছের পাতাকে এমনভাবে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে যে, সেটা একটা বিশালাকৃতির টিউলিপের কুঁড়ির আকৃতি পেয়েছে।

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

প্রতিবছরই অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাতে অনেক বড় পরিসরে টিউলিপ মেলা হয়। কিন্তু সিডনি থেকে গাড়ি চালিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে টিউলিপ মেলায় দর্শনার্থী হওয়া অনেক খাটুনির। তাই মনে মনে সিডনিতেই এমন কোনো মেলা হয় কিনা খোঁজ নিচ্ছিলাম অনলাইনে। ভাবনাটা মেয়ে তাহিয়ার বান্ধবী জেইনার মা ফাহিমাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, সিডনিতেই প্রতিবছর টিউলিপ মেলা হয়। ক্যাম্বেলটাউন থেকে মাত্র এক ঘণ্টার ড্রাইভ। আর আপনি যদি সিডনি থেকে যেতে চান তাহলে আরও আধঘণ্টা সময় বেশি লাগতে পারে। জেইনার বাবার সপ্তাহান্তে কাজ থাকে তাই পরিকল্পনা করা হলো সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবারে আমরা টিউলিপ মেলায় যাব। টিউলিপ মেলা চলে সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

সকাল সকাল আমরা রওনা দিলাম। করবেট গার্ডেনে পৌঁছার পর পার্কিংটা আপনাকে নিজ দায়িত্বে খুঁজে নিতে হবে। তারপর লাইনে দারিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলেই আপনি আপনার ইচ্ছেমতো সময় ধরে ভেতরে অবস্থান করতে পারবেন। ১২ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের কোনো টিকিট লাগবে না। বড়দের টিকিটের মূল্য মাত্র ১২ ডলার। শুক্রবার কর্ম দিবস হওয়ায় গার্ডেনে তেমন একটা ভিড় ছিল না। আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম বয়স্কদের স্থানীয় একটা সংগীত সংগঠনের শিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে গান পরিবেশন করছেন। পরে বয়স্কদের আরও একটা সংগঠন বিভিন্ন দেশের গানের তালে তালে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করল। এই নৃত্য পরিবেশনা আমন্ত্রিত দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি পেল। অংশগ্রহণকারীদের বয়স অনেক হলেও পরিবেশনা দেখে মনে হলো একদল টিনএজার তাদের নৃত্য পরিবেশন করছে। দর্শকদের মধ্যে অনেকেই নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে অংশগ্রহণ করল। ছোট রায়ান ও জাহিয়াও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচ শুরু করে দিল।

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

পরিবেশনা শেষ হওয়ার পর আমরা সারা গার্ডেন ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। সেই সঙ্গে ফাহিমা ও সজিব তাদের মোবাইলের ক্যামেরাতে ছবি তুলে চলল। ছবি সুন্দর আসছিল। মোট ১৩টা বেডই আমরা ঘুরেঘুরে দেখলাম। তবে ২, ৫ ও ৯ নম্বর বেডের কথা আলাদা করে বলা দরকার। বিশেষ করে ৫ নম্বর বেডটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর। বেডের মাঝ বরাবর একটা ছোট কৃত্রিম নদী বয়ে গেছে। তার পানিতে বর্ণিল প্লাস্টিকের প্রজাপতি ভাসছে। এর শেষ প্রান্তে পাথরের ওপর রয়েছে একটা শ্বেতশুভ্র মৎস্য কুমারীর মূর্তি। আমরা ঘুরে ঘুরে বেডগুলো দেখছিলাম। ওদিকে রায়ান ও জাহিয়া প্রতিটা বেডের ধারে গিয়ে বসে পড়ছিল। তাদের সেখান থেকে ওঠাতে রীতিমতো জোর করতে হচ্ছিল। আসলে কোন সৌন্দর্য কীভাবে মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে হয় তার পাঠ আমাদের শিশুদের কাছ থেকেই নেওয়া উচিত।

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

মেলার মধ্যে এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের দোকান। একেবারে জুতার মোজা থেকে শুরু করে টিউলিপের গাছ পর্যন্ত সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। তবে আমাদের আকর্ষণ করল ইমাজিন আর্ট বলে একটা দোকান। একজন হাসিখুশি নারী দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা কাছে যেতেই তিনি বললেন তোমাদের বাচ্চারা পছন্দ করবে এমন কিছু সামগ্রী আমার কাছে আছে। এগুলো বিক্রয়ের জন্য নয় তবুও আমিও চাই ওরা সেগুলো দেখুক। আমি নিশ্চিত ওরা অনেক মজা পাবে। তিনি বিভিন্ন আকৃতির পুতুল তৈরি করেন। আবার সেগুলো দিয়ে নিজেই বিভিন্ন জায়গায় পুতুল নাচ দেখিয়ে বেড়ান। টিউলিপ মেলা উপলক্ষে তিনি টিউলিপ আকৃতির বেশ কিছু পুতুল তৈরি করেছেন। সেগুলোর নিচের কাঠি ধরে ওপরের দিকে চাপ দিলেই ভেতর থেকে সুন্দর টিউলিপ আকৃতির পুতুল বের হয়ে আসছিল। তাহিয়া, জেইনা আর জাহিয়া সেই পুতুল নিয়ে খুব আগ্রহভরে খেলা শুরু করে দিল। রায়ান বেশ দুষ্টুমি করছিল বলে আমি ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম এমন কোনো পুতুল আছে কিনা যেটা দেখিয়ে ওকে শান্ত করা যায়। তখন তিনি গ্রাবি নামের একটা বিদঘুটে আকৃতির পুতুল বের করতেই রায়ান আমার পেছনের এসে লুকাল। তিনি গ্রাবিকে হাতে নিয়ে তার মিমিক্রি আওয়াজ আমাদের শোনালেন।

মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ
মেলায় নানা প্রজাতি ও বর্ণের টিউলিপ

মেলায় এ ছাড়া ছিল স্থানীয় সিনিয়র সিটিজেনদের একটা গিফট শপ ও চায়ের স্টল। সেখান থেকে আপনি আপনার প্রিয়জনের জন্য নানা রকমের সুভেনির কিনতে পারেন। আর খাবারের জন্যও বেশ কিছু দোকান আছে। বাচ্চাদের খিদে পেয়ে গিয়েছিল বলে আমরা একটা দোকান থেকে ডোনাট কিনে নিলাম। তারপর ফাহিমা গিয়ে তাদের সঙ্গে আনা ফ্রায়েড চিকেন নিয়ে এলে আমরা সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর জেইনারা চলে গেলে আমরা আরও কিছুক্ষণ মেলাতে থাকলাম। কারণ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মেলা শেষে আমাদের নওরা যেতে হবে। একটু পরেই স্থানীয় স্কুলের বাচ্চাদের একটা সংগঠন লিনহাম হাই ব্যান্ড বিভিন্ন রকমের কম্পোজিশন পরিবেশন করল। পঞ্চাশের ওপরে বাচ্চা বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে একেকটা সুর শুনিয়ে গেল দর্শকদের। অনেক দিন পর সামনাসামনি যন্ত্র সংগীত শুনলাম। শুরুতে ভেবেছিলাম ভালো লাগবে না। কিন্তু শুনতে শুরু করতেই এক ধরনের অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল। আসলে সামনাসামনি যেকোনো ধরনের সংগীতের আবেদন অনেক বেশি থাকে।

ছেলেমেয়েসহ লেখক ও তার সঙ্গীরা
ছেলেমেয়েসহ লেখক ও তার সঙ্গীরা

অবশেষে এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলে আমরা ফেরার পথে পা বাড়ালাম। তবে ইচ্ছে আছে এখন থেকে প্রতিবছর টিউলিপ মেলাতে যাওয়ার। আপনিও আপনার পরিবার বন্ধুবান্ধব নিয়ে সদলবলে চলে যেতে পারেন বওরালের করবেট গার্ডেনে। আশা করি দিনটা আপনার দারুণ কাটবে। একটা কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। সারা বাগানে ঘুরলেও আপনার শরীরে এক ধরনের অদ্ভুত কোমল অনুভূতি কাজ করবে।

মো. ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>