দিঘল মেঘের দেশে-তেরো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রেস্টুরেন্টে মায়ার্স থেকে কেনা হ্যান্ড ব্যাগ ও ঘড়ি দেখে পিটার যতটা খুশি হয়েছিল, লিডিয়া ততটা খুশি হয়নি। জাহিদ ভাবল, লিডিয়ার মনে না জানি কী ছিল? আগামী সপ্তাহে কাগজের বিয়ের সমাপ্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো বাড়তি টাকাপয়সার পথটা বন্ধ হয়ে যাবে। গত দেড়টা বছর লিডিয়া বেশ আয়াসেই ছিল। কাগজের বিয়ের জন্য যা নেওয়ার কথা লিডিয়া তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ টাকাপয়সা জাহিদের কাছ থেকে নিয়েছে।

আজমল হোসেনের জন্যও জাহিদের খারাপ লেগেছিল। তাকে ফেলে রেখে সাধারণত সে ওসব রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খায় না। আজ তাকে খেতে হয়েছে। যাওয়ার আগে অবশ্য সে আজমল হোসেনকে পার্ক স্ট্রিট, পাশের লরেন্স স্ট্রিট ও কারামু রোডের এপাশটায় খুঁজে গেছে। কিন্তু কোথাও তার টিকিটি পর্যন্ত পায়নি।

জাহিদ রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে ড্রাইভওয়ের একপাশে গাড়িটা পার্ক করে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে ভাবল, আজমল স্যার নিশ্চয়ই এরই মধ্যে বাসায় ফিরেছেন। কিন্তু বাসায় ঢুকে আজমল হোসেনের রুমে উঁকি মেরে দেখল, তিনি এখনো ফেরেননি। মোবাইলটা টি-টেবিলের একপাশে আগের মতোই পড়ে আছে।

জাহিদ কাপড়চোপড় না ছেড়েই সোফায় বসল। সোফায় বসেই রিমোট দিয়ে টিভি চালু করল। আজ শনিবার। টিভির প্রতিটা চ্যানেলেই এখন ইংরেজি মুভি চলছে। চ্যানেল টু-তে সব সময় ব্লকবাস্টার মুভিগুলো দেখায়।

জাহিদ রিমোটে চ্যানেল টুর বাটন চাপতেই দেখল, রাসেল ক্রোর গ্ল্যাডিয়েটর মুভিটা চলছে। মুভিটা বেশ ভালো। রাসেল ক্রো এই মুভিতে অভিনয়ের জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

হলিউডের এই অভিনেতার জন্ম নিউজিল্যান্ডে বলে তার প্রতিটা মুভিই এখানকার টিভি চ্যানেলগুলোতে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখায়। হলিউডের আরেক বিখ্যাত পরিচালক পিটার জ্যাকসনের জন্মও এই নিউজিল্যান্ডে। পিটার জ্যাকসনও তাঁর পরিচালিত বিখ্যাত ট্রিলজি দ্য লর্ড অব দ্য রিংয়ের জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

গ্ল্যাডিয়েটর মুভিটা জাহিদের আগেই দেখা। নতুন যখন মুক্তি পায় তখনই সে নেপিয়ারের ইভেন্ট সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছে। মুভিটা যেহেতু তার আগেই দেখা, তাই সে চ্যানেল পরিবর্তন করে দিল। রিমোটে চ্যানেল থ্রির বাটন চাপতেই দেখল, সেখানে একটা সামাজিক ছবি চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখার পরও সে ছবির কাহিনি ঠিক বুঝতে পারল না। হয়তো মুভিটা প্রথম থেকে দেখলে বুঝতে পারত। রিমোটে চ্যানেল ওয়ানের বাটন চেপে দেখল, হ্যামলেট বা ম্যাকবেথ টাইপের পুরোনো ধাঁচের কী একটা ছবি চলছে।

জাহিদ বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে দিল। আরও কিছুক্ষণ গা ছেড়ে বসে সে এবার সোফার ওপর পা তুলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তার দৃষ্টি ছাদে। ছাদের সিলিংয়ে সরু সরু কী সব রেখা। দুই বেডরুমের ছোট্ট একটা বাসা তাদের। এ বাসাতে তারা পাঁচ বছরের মতো হলো বসবাস করছে। একই বাসায় একই ছাদের নিচে আজমল হোসেনের সঙ্গে পাঁচটা বছর বসবাস করতে করতে কত স্মৃতিই না জমা হয়েছে।

জাহিদের তখন নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আজমল হোসেনকে প্রথম দেখার স্মৃতিটা মনে পড়ল। আজমল হোসেনকে প্রথম দেখার পর সেই রাতটাও ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতার রাত।

নিউজিল্যান্ডে আসার আগে জাহিদের জানা ছিল না তারই কলেজের রসায়নের শিক্ষক আজমল হোসেন এই নিউজিল্যান্ডে। কলেজ ছাড়ার পর সে আর কখনো কলেজমুখো হয়নি বলে এ খবরটা তার কানে আসেনি।

সবে জাহিদ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়েছে। জাহাজ থেকে বে অব প্ল্যানটির তাওরাঙ্গা পোর্টে নেমে সে হকস বে অঞ্চলে আসার আগে প্রথম কিছুদিন জাহিদ ছোট্ট শহর টিপুকিতে কিউই ফলের অরচার্ডে কাজ করেছিল। একদিন টিপুকির কাছে মাকিটুর এক অরচার্ডে কাজ করতে গিয়ে আজমল হোসেনকে দেখে তো অবাক। আজমল হোসেনও সেই অরচার্ডে কাজ করছিলেন। পরিচয় দিতেই আজমল হোসেন জাহিদকে চিনতে পারেন। তবে অরচার্ডে কাজের ব্যস্ততায় ওদের মধ্যে খুব সামান্যই কথাবার্তা হয়।

সেদিন বিকেলেই আজমল হোসেন মিন্টু মোল্লা নামে এক ভদ্রলোকের গাড়িতে জাহিদদের বাসায় এসে হাজির। জাহিদ তখন হালিম নামে তার সমবয়সীর পাপামোয়ার বাসায় অস্থায়ীভাবে থাকত। ¾

ওখান থেকে আজমল হোসেন ও মিন্টু মোল্লা জাহিদকে তাদের মাউন্ট মাঙ্গানুইর গ্রেইস রোডের বাসায় নিয়ে যান।

তখন নিউজিল্যান্ডে গ্রীষ্মকাল। ডিসেম্বরের শেষ। একত্রিশ তারিখ। রাতের খাবারের পর মিন্টু মোল্লাই প্রস্তাব দেন, চলুন, আমরা মাউন্ট মাঙ্গানুই বিচ থেকে ঘুরে আসি। আজ থার্টি ফার্স্ট নাইট। মাউন্ট-মাঙ্গানুই বিচে খুব জমবে।

মিন্টু মোল্লার প্রস্তাবে আজমল হোসেন রাজি হয়ে যান। জাহিদও বেশ আগ্রহ বোধ করে।

তারা রাত পৌনে এগারোটার সময় বাসা থেকে বের হলো। হেঁটেই রওনা হলো। মাউন্ট মাঙ্গানুই মেরিন প্যারেডে গাড়ি নেওয়ার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। থার্টি ফার্স্ট নাইট বলে সব রাস্তা বন্ধ ছিল। তবে মিন্টু মোল্লা বা আজমল হোসেনের গ্রেইস রোডের বাসা থেকে বিচ খুব বেশি দূরে ছিল না। মাত্র দশ মিনিটের হাঁটার পথ।

জাহিদ বিচে এসে দেখে, সত্যি বিচটা খুব সুন্দর। সারি সারি পাইন ও পাম গাছ। বিস্তৃত সবুজ ঘেরা ঘাসের লন। দিগন্ত বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগরের জল। বিচের একপাশে বালুকা রাশি তো অন্যপাশে বিশাল বিশাল পাথর। সামান্য দূরেই পাথরের দ্বীপ। বিচ ও সমুদ্র ঘেঁষেই একটা বড় পাহাড়। সমুদ্রের জল সেই পাহাড়ের বড় বড় পেট বের হওয়া পাথরে এসে আছড়ে পড়ছে-ছলাৎ ছলাৎ ছলাৎ। ¾

জাহিদ মিন্টু মোল্লার কাছে জেনে নেয়, পাহাড়টার নাম মাউন্ট মাঙ্গানুই। এই পাহাড়ের নামেই মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরটার নাম রাখা হয়েছে। পাশাপাশি তাওরাঙ্গা শহরটা বিজনেস সিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বলে মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরটা সাধারণত খুব শান্ত হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বড়দিন বা নববর্ষের সময়টায় মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরটা বেশ সরগরম হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা তো আসেই। নিউজিল্যান্ডেরও বিভিন্ন শহরের লোকজন এই শহরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সারি সারি হোটেল-মোটেলগুলোতে কোনো রুম খালি থাকে না। সমুদ্রের দিকে মুখ করা অভিজাত বাড়িগুলোতে বিভিন্ন আলোকসজ্জা শোভা পায়।

তারা হাঁটতে হাঁটতে একসময় প্রধান বিচে চলে আসে। প্রধান বিচে মানুষ আর মানুষ! সারি সারি পাইন গাছ আর পাম গাছের ধার ঘেঁষে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। প্রায় প্রত্যেকটা দোকান ছিল পানীয় ও আইসক্রিমের। পাশেই বিশাল মঞ্চে কনসার্ট হচ্ছিল। কনসার্টের গানের তালে তালে তরুণ-তরুণীরা উত্তাল নৃত্য করছিল।

তারা তিনজন কোথাও না থেমে হাঁটছিল। তিনজন পাশাপাশি হাঁটার চেষ্টা করলেও জাহিদ বারবারই পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। তার ভেতর তখন বিরাট একটা অনুভূতি কাজ করছিল। কোথায় সে ছিল, কোথায় সে এসেছে? মাত্র আড়াই মাস আগেই সে চট্টগ্রাম পোর্টে ছিল। তারপর দুই মাস সিঙ্গাপুরের এক জাহাজে সমুদ্রের পর সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে। গত পনেরো দিন আগেই সেই সিঙ্গাপুরের জাহাজ থেকে সে সটকে গেছে। সটকে গিয়ে সে পাপামোয়া শহরতলিতে পূর্ব পরিচিত হালিমের বাসায় গিয়ে ওঠে। আজ সে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ইংরেজি নববর্ষ পালন করতে এসেছে!

নতুন কোনো স্থানে এলে সবকিছুই যেমন অদ্ভুত লাগে। জাহিদের কাছে তেমনই লাগছিল। এরই মধ্যে মিন্টু মোল্লা সবার জন্য আইসক্রিম কেনেন। সবার মধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগরের মুগ্ধতা। আর কিছুক্ষণ, তারপরই নতুন একটা বছরের শুরু।

তাদের আইসক্রিম তখনো শেষ হয়নি। হঠাৎ করেই কনসার্টের গান থেমে যায়। সর্বত্র একটা স্তব্ধতা নেমে আসে। ফিফটি ফাইভ, ফিফটি সিক্স, ফিফটি সেভেন, ফিফটি এইট, ফিফটি নাইন, সিক্সটি...!

সবাই হুল্লোড়ে মেতে ওঠে আর একযোগে বলে ওঠে হ্যাপি নিউ ইয়ার্স।

চারদিকে আতশ বাজি জ্বলে ওঠে। যারা বিয়ার খাচ্ছিল, তারা বোতলে বোতল ঠেকায়। যার ওয়াইন খাচ্ছিল, তারা গ্লাসে গ্লাস ঠেকায়। চারদিকে কোলাহল আর হই হুল্লোড়।

তারা তিনজন কোলাহল আর লোকজনের ভিড় ঠেলে সারি সারি পাইন গাছের তীর ছেড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তৃত বিচের বালুকা রাশিতে নেমে আসে। তখন সমুদ্রে ভাটার টান ছিল। সমুদ্রের জল আর ঢেউ ছিল অনেকটা নেমে গিয়ে ভেতরে। বালুকা রাশির ওপরও অনেক লোকজন। প্রায় সবাই এলোমেলোভাবে হাঁটছে। কেউ কেউ গোল হয়ে বসে আছে।

জাহিদরা সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে।

তীরের আলোকসজ্জার আলো ও রাস্তার বাতিগুলোর আলো বিস্তীর্ণ বালুকা রাশিতে এসেও পড়ছিল। তারা সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তখনো ঠিকমতো পৌঁছেনি। হঠাৎ জাহিদ যা দেখে, তাতে তার তৎক্ষণাৎ মনে হয় তার এতক্ষণের সমস্ত ভালো লাগাটা যেন একঝাঁক শকুন এসে ঠোঁট বাড়িয়ে ঠুকরে দিচ্ছে! জাহিদ দেখে, বিস্তীর্ণ বালুকা রাশির এক প্রান্তে অনেকগুলো জোড়ায় জোড়ায় যুবক যুবতী। নগ্ন ও অর্ধনগ্ন। ওদের মধ্যে এক আদিম খেলা চলছে। ওদের কোথাও কোনো রাখঢাক নেই।

জাহিদ তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে, সেই যুবক-যুবতীরা নগ্নতা দিয়ে নববর্ষকে উদ্‌যাপন করছে।

আজমল হোসেন তো এক লাফে পেছন ফিরে বলেন, এটা কী, এটা কী? নাউজুবিল্লা! বলেই তিনি এক মুহূর্ত দেরি না করে হন হন করে পাইন গাছের পাড়ের দিকে হাঁটা ধরেন।

জাহিদ বুঝে উঠতে না পেরে মিন্টু মোল্লার দিকে তাকায়। মিন্টু মোল্লা ছিলেন খুব কালো। তার গায়ে রং নিগ্রোদেরও হার মানাত। জাহিদ সেই আধা আলোতেও মিন্টু মোল্লার দাঁতগুলো এক ঝলক দেখে। এরই মধ্যে দুটো মেয়ে উল্টোদিক থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। কাছাকাছি হয়েই বলে, হাই।

মিন্টু মোল্লা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলেন, হাই।

একটা মেয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাপি নিউ ইয়ার্স।

জাহিদ বাধ্য হয়ে বলে, হ্যাপি নিউ ইয়ার্স।

মেয়েটা আরেকটু এগিয়ে এসে বলে, ডু ইউ ওয়ান্ট টু সেলিব্রেট নিউ ইয়ার্স? অনলি হান্ড্রেড ডলার।

জাহিদ তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে মেয়েটা কীসের সেলিব্রেটের কথা বলছে। সে নড়ে চড়ে ওঠে। এমনিতেই সে তখন নিউজিল্যান্ডে একেবারেই নতুন, অত-শত বোঝে না!

মেয়েটা আরও দুই পা এগিয়ে আসতেই জাহিদ ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে সে বলে ওঠে, নো, নো, নো! বলেই সে দৌড় দেয়। সে কী দৌড়! পাইন গাছের তীরের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে একবার পেছন ফিরে দেখে, মিন্টু মোল্লাও থলথলে ভুঁড়ি নিয়ে তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছেন।
এর কিছুদিন পরই জাহিদ ও আজমল হোসেন হেস্টিংস চলে আসে। তারপর এই পাঁচটা বছর একই ছাদের নিচে থাকতে থাকতে তাদের ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের বাইরেও এক ধরনের আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আজমল হোসেন বাল্যকালের কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। খুব অল্প বয়সে তার বাবা মারা যান। পড়পশোনা শেষ করেই কলেজের চাকরি নেন। এই চাকরির টাকায় ছোট ভাইবোনগুলোকে তাকে টানতে হয়েছিল। এ জন্য তিনি বিয়ে করেন বেশি বয়সে। তিনি যখন নিউজিল্যান্ডে আসেন তার ছেলের বয়স মাত্র আট বছর।

আজমল হোসেনের ছেলেটার নাম অনন্ত। তার বয়স এখন চৌদ্দ বছর। মাস দুই আগে অনন্ত ফেসবুকে চৌদ্দতম জন্মদিনের অনেকগুলো ছবি পোস্ট করেছে। আজমল হোসেন ফেসবুক এত বোঝেন না। জাহিদই বুঝিয়ে দেয়। সেদিন আজমল হোসেন ফেসবুকে ছেলের ছবি দেখে খুব কেঁদেছিলেন।

অনন্ত দেখতে আজমল হোসেনের মতো ফরসা ও লম্বা হয়েছে। কিন্তু আজমল হোসেন এত সহজ-সরল যে, ছয় বছর আগে বাংলাদেশ ছেড়ে আসার সময় অনন্তের যে প্রিন্ট করা একটা ছবি নিয়ে এসেছেন ওটা নিয়েই তিনি প্রতিনিয়ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। সময়-সময় কাঁদেন। নতুন কোনো ছবি দেখেও তিনি পুরোনো সেই আট বছর বয়সী অনন্তের মাঝে ফিরে যান। তিনি ভুলেই যান যে অনন্তের চৌদ্দ বছর হয়েছে। মাঝখানে ছয়টা বছর চলে গেছে।

জাহিদ আড়াল থেকে ছেলের জন্য আজমল হোসেনের কান্না বহুবার দেখেছে। তার একটাই কথা, জাহিদ, নিজের জীবনে তো কিছুই করা হলো না। জীবনও প্রায় শেষ। এখন ছেলেটার যদি নিউজিল্যান্ডে একটা ব্যবস্থা যেতে পারি!

রাত আরও বাড়ছে। জাহিদ রিমোটে টিভি অন করতে গিয়েও করল না। সামনের দরজায় একটা শব্দ হলেই তার কান খাঁড়া হয়ে উঠছে, এই বুঝি আজমল স্যার এলেন। কিন্তু রাত প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে। এখনো আজমল হোসেনের কোনো খবর নেই। মাঝেমধ্যে যে তিনি এক-দুই রাতের জন্য উধাও যাননি, তা নয়। দু-চার বার না বলেই বাসে তাওরাঙা-টিপুকিতে চলে গেছেন। কিন্তু তখন তো তিনি মোবাইলটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। অন্তত মোবাইলে জানা গেছে যে তিনি কোথায়।

টি-টেবিলের ওপর আজমল হোসেনের মোবাইলটা লো-ব্যাটারির জন্য কিছুক্ষণ পর সিগন্যাল দিচ্ছে পিৎ পিৎ, পিৎ পিৎ। জাহিদ সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে আজমল হোসেনের মোবাইলটা মোবাইলটা চার্জে দিল। বেডরুমে চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই সে আবার সোফায় এসে বসল। সে নেপিয়ারের সি-ফুড রেস্টুরেন্ট থেকে আজমল হোসেনের জন্য প্লাস্টিক কন্টেইনারে করে খাবার নিয়ে এসেছে।

জাহিদ সোফায় বসা অবস্থায় ঘাড় ঘুরিয়ে একবার খাবারগুলো দেখে ভাবল, এরই মধ্যে যদি আজমল স্যার চলে আসেন? আর তিনি বাসায় ফিরে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা খাবারগুলো না দেখেই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, তাহলে তো খাবারগুলো নষ্ট হবে? তার যা ভুলো মন! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া: ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1558691