জানালায় আসে না কেউ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিল্ডিংয়ের সামনে বিশাল দিঘি। দিঘির জলে রোদ পড়লে কাচের টুকরোর মতো চিক চিক করে। দুপুর হলেই পাঁচ বিল্ডিংয়ের মানুষজন নামে সেই কাচের দিঘিতে।

নিচতলায় বোতল কাকাদের বাসা। কোন কারণে বা কি অপরাধে তার নাম বোতল হয়েছিল জানি না। শুধু জানি সবাই আড়ালে তাকে বোতল ডাকত! ওপরতলা দেলোয়ারের দাদির। দেলোয়ারের দাদির থুতনিতে দাঁড়ি ছিল গোটা দু-এক। কত দিন গোপনে ভেবেছি বুড়ির দাঁড়ি চুরি করার! বুদ্ধিটা সুজনের দেওয়া।

সুজনের বাবা ডিসির গাড়ি চালাত। আবদুর লতিফ। সরকারি গাড়ির গুনে তারা তখন তেলে ভাসে। গাড়ির তেলে! সুজন আমার বন্ধু। ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমি প্রথম সুজনের প্রতিভা দেখি। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হই। দুই হাতে, পেটে ও ঊরুতে-বল পয়েন্ট দিয়ে সব নামতা লিখে এনেছিল সুজন। আর আমি সেটা দেখে দেখে পরীক্ষার খাতা ভরিয়েছি! নকলের জন্য যদি কোনো মেডেল দেওয়ার নিয়ম থাকত তবে সুজনকে তা দিতাম। সঙ্গে একটা মানপত্র-‘হে মহান, আপনার এই অভূতপূর্ব নকল কৌশলে আমরা আনন্দিত, গর্বিত। আপনার সারা অঙ্গে নামতা লেখার অবদান জাতি চির স্মরণীয় করে রাখবে!’

সুজনই আমাকে বলেছিল দেলোয়ারের দাদির দাঁড়ির মূল্য কোটি টাকা! নিতে পারলেই রাজা। আমি রাজা হওয়ার জন্য বহু কাঠখড় পুড়িয়েছি। কিন্তু পারিনি। কারণটা দুঃখের। দেলোয়ারের দাদি আমাদের বাসায় এসে কোনদিন ঘুমাননি। পান খেয়ে গল্প করেই চলে যেতেন। দাড়িটা ছিঁড়ে নেওয়ার সুযোগ আর হয়নি কখনো। আহারে আমার কোটি টাকার দাঁড়ি। লালনের অচিন পাখির মতন কেমনে আসে যায়!

বড় ভাইয়ের বন্ধুর নাম ইকবাল। ইকবাল ভাইয়ের বাবা সাইজে ছোট কিন্তু স্বভাবে আবেগী। মেজ ভাইয়ের ফুটবল দায়ের কোপে কেটে ফেলেছিলেন তিনি। আলিফ-লায়লার মালিকা হামিরার মতন! কারণ সেই বল তার পালং খেতে পড়েছিল! মেজ ভাই সেই শোকে মুখ কালো করে ঘুরেছে বহুদিন। পালং শাক তার মুখে উঠত না আর। অবশেষে মেজ ভাই অভিশাপ দিলেন। ইকবাল ভাইয়ের বাপের এক মন মিষ্টি জলে গেল, কুমিরে খেল।

ইকবাল ভাইয়ের বাবা ফরিদ বেকারি থেকে মিষ্টি এনে পাঁচ বিল্ডিংয়ে বিলি করেছিলেন। কারণ ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বের হয়েছিল সেদিন। দাউদ, টিংকু ভাই সবাই ফেল। থার্ড ডিভিশনে পাস করে ইকবাল ভাই তখন বাপের মাথার মুকুট, মায়ের সাত না সত্তুর রাজার ধন!

জল কুমিরের গল্পটা ছড়াল অবশ্য কিছুদিন পর। যখন এসএসসির মার্কসিট এল। ইকবাল ভাই সাত বিষয়ে ফেল। পাসের কথাটা মিথ্যে বলেছিলেন তিনি। খবর রটে গেলে ইকবাল ভাই বাসা ছেড়ে পালালেন। তার বাপ তখন শয্যাশায়ী। জ্বরের ঘোরে তিনি শুধু বকেন-ফেলের লস মানা যায়। মিষ্টির লস কেমনে সইরে ইকবাইল্লা!

লস করেননি সুমন ভাই আর মেজ ভাই। তাদের লাভের খাতায় ঘুড়ি আর ঘুড়ি। শাগরেদ ছিল রহিম। রহিম পুরোনো বাল্ব খুঁজে এনে সেটা গুঁড়ো করে মাঞ্জা বানায়। পুরোনো বাল্ব না পেলে নতুনগুলো খুলে আনতেও পারদর্শী রহিম!

২৬ নম্বরের ছাদে দাঁড়িয়ে বীরের মতো আমার মেজো ভাই ঘুড়ি ওড়াতেন। লাটাই হাতে কেটে নামাতেন আকাশের সব কটা ঘুড়ি। আমার গর্বে বুক ভরত। আমি একজন মহান ঘুড়ি বীরের ভাই বলে!

তখন দিন ছিল নাটাই ঘুড়ির। রাত ছিল লোডশেডিংয়ের। আর জীবন-সেটা গঙ্গা ফড়িংয়ের মতো, দুই টাকার নোটে আঁকা দোয়েল পাখির মতো। হলুদ প্রজাপতির মতো। তেমন একটা প্রজাপতি আমার বড় ভাইকে ভালোবাসত। আজ আর মনে পড়ে না তার নাম। মনে পড়ে না তার রং। শুধু মনে পড়ে বড় ভাই ভালোবাসা বোঝার আগেই এক সন্ধ্যায় ট্রেনে ওঠেন। অনেক মাঠ, হাট, পাহাড় ডিঙিয়ে চলে যান সিলেট। জল ভরা চোখে সেই কিশোরীর অভিমান কী তীব্র ছিল!

আমি জানি না। জানি না কতটা ভালোবাসলে মানুষ কাঁদে। কতটা ঘৃণা করলে ছেড়ে যায়। কতটা অভিমানে কাঠবাদামের পাতা ঝরে। ঢেউ ওঠে বুকের গভীরে। খুব গোপনে।

শুধু জানি, ভালোবেসে চলে যেতে নেই...!

দুই.

তখন সময়টা ছিল ডিশ অ্যানটেনার। বড় একটা ছাতা এল। জালি দেওয়া লোহার। এত বড় ছাতা আমি আগে দেখিনি কোনো দিন। তার ওপর হাজারো ফুটো। চালের ঝাঝের মতন!

টাউন হলের মোড়ে ছিল আরেকটা ছাতা। ট্রাফিক পুলিশের। একটা বয়স্ক ট্রাফিক পুলিশ সেই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বারো মাস হুইসিল দিতেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তার হুইসিল শুনেই কেটেছে। আমার তখন খুব ট্রাফিক পুলিশ হতে ইচ্ছে করত। রাতে ঘুমালে সেই বয়স্ক ট্রাফিক পুলিশকে স্বপন দেখতাম। তার মোটা ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলে থাকা রুপালি বাঁশিটা দেখতাম। একটা বাঁশির জন্য, শুধু একটা বাঁশির জন্যই আমার ট্রাফিক হতে চাওয়া! টাউন হলের চৌরাস্তায় সেই ছাতার নিচে কালো রঙের ক্যাবল ফিট করা ছিল না। ক্যাবলের মাথায় ছিল না জাদু। ছিল শুধু গালের কোণে চুন লেগে থাকা, পান খাওয়া বুড়ো এক ট্রাফিক।

হোটেলটার নাম মনে নেই। সাইন বোর্ডের দুই পাশে দুটো খাসির ছবি আঁকা ছিল। এটা মনে আছে। হোটেলটা ছিল চৌমুহনী রেল স্টেশনে। সকাল সাতটার ট্রেনে সোহেল আর আমি যেতাম ইস্কুল পালিয়ে। সপ্তায় তিন দিন। মাইজদী স্টেশন পেরোলে লোহার ব্রিজ। তারপর চৌমুহনী, তারপর সেই হোটেল। ধোঁয়া ওঠা শিঙারা খেতে খেতে জিব পুড়ে গেছে কত দিন। কারণ ডিশ অ্যানটেনা! সেই জাদুর ছাতার গুনে হোটেলটা টইটম্বুর তখন। ২১ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনের বুকের ভেতর নেচে নেচে গান গাইত লম্বা চুলের এক যুবক। এক বছর পর জেনেছি তার নাম শাহরুখ খান। যখন ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করলাম। ক্লাস সিক্সে দুই বছর থাকলাম। তখন পুরোপুরি জানলাম তার নাম আসলেই শাহরুখ খান! যে কিনা আমায় ফেল করাল!

আমার স্কুল পালানো, পরীক্ষায় ফেল, ট্রেনে ঘোরা আর ডিশ অ্যানটেনা পাশ কাটিয়ে একদিন প্রিয় হয়ে গেল নোয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরি আর থিয়েটার। যেখান থেকে আমার নাটকের শুরু। আজকের পরিচালক হয়ে ওঠা!
...

হিমু আকরাম: হাই পয়েন্ট স্ট্রিট, নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>