চলে গেছে নিঃসঙ্গ সামার

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সূর্যের আলোর মাঝে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি এই আসছে, এই যাচ্ছে। মেঘের মুখ ভারী। নদীপাড়ের বাড়িটার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে পিচ্চি বিড়ালটাকে আদর করতে করতে হঠাৎ খেয়াল হলো, শীত এসে গেছে! ইদানীং তাই অমন ভরদুপুরে বাচ্চা বাচ্চা রোদ নেমে রোজ ঝাপটা মারে বিড়ালটার মতো। দখিনের মৃদু বাতাসের সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে এক মুঠো রোদ। সামার এসে পুরো নগর পুড়িয়ে কবে যে আবার ঘরমুখো হলো, টেরই পেলাম না! আহা, এবারের সামারটা আমার, সমুদ্রের ঢেউয়ে না ভিজেই চলে গেল। বালুকাবেলায় এক চিলতে মেঘের আকাশ চোখ খুলে না দেখে, সাদা গাঙচিলের ঝাঁকের পিছে পিছে বহুদূর না ছুটে, পাহাড়চূড়ায় উঠে দুঃখ মাখা সূর্যের চলে যাওয়ার মুহূর্তে জীবনের হিসাব-নিকাশে না বসে, ভরা চাঁদরাতে সৈকতের মাঝখানে তাঁবু গেঁড়ে রাত পার না করে—আমার কখনো ইউরোপের সামার কাটেনি। গেল বছরগুলোয় কখনো মেডিটেরিয়ান, কখনো নর্থ সি, কখনো বাল্টিক, আবার কখনো অ্যাড্রিয়াটিক সি অথবা আটলান্টিকের পাড়ে নোঙর করেছিলাম। অথচ এবার আমি কোথাও যাইনি। যেতে পারিনি। কবি কবি চেহারার কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো অমলের মতো আমার নামটাও যেন মুছে যাবে সামারের পেট থেকে।

সত্যি বলছি। এখানে কোথাও কেউ আমার কবিতা ছাপেনি!

সেবার প্ল্যান করে রেখেছিলাম এই সামার নিয়ে। প্ল্যান ছিল, এ বছর আমার ষোলো আনা একটা প্রেম হবে, বিয়ে হবে, ভালোবাসাবাসির চিঠি হবে, ইতালি বা গ্রিসের কোনো এক সমুদ্র দ্বিপের মোহনায় বসে পুরোনো দিনের মতো করে আমি লিখব, প্রিয় আকাশি, গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি! কত দিন পর তোমার চিঠি...। নাহ, কিছুই হয়নি। অনেকেই বলে, প্ল্যান করে ভালোবাসা হয় না। কিন্তু আমার না করেও হয় না, করেও হয় না। এক আজীব প্রেম ভাগ্য নিয়েই প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি। উঠতে হয়।

আগেকার বছরগুলো দেখতাম, অনেক লম্বা। রেললাইনের মতো। ফুরাতে চায় না। আর এখনের বছরগুলো মনে হয়, গ্রামের ধানখেতের আলপথ। ছেলেবেলায় খেলার ছলে পয়সা বা খেলনাপাতি খোয়ানোর মতো হারিয়ে ফেলছি একেকটি বছর। তার মাঝে কিছু সময় যেন বিষ পিঁপড়ের কামড়। লোকে বলে বয়স বাড়ছে আমার, আমি বলি এটা শুধু একটা সংখ্যা। বাড়াবাড়ির কিছু দেখি না তো! আমি তো স্থির হয়ে আছি স্বপ্নের ভেতর। তবুও বয়েসের ভারে অথবা এ অনন্ত ছোটাছুটিতে খুব ক্লান্ত হয়ে আজকাল একটা বদ অভ্যাস হয়েছে। দুপুরের ভাতঘুম। আমি যখন ঘুমোই, সবকিছু এক পাশে ফেলে ঘুমোই। মাঝেমধ্যে এই ঘুমের ভেতর একটা বাঁশির সুর এসে বাজে। মনে হয়, বহু, বহুদূর...আরও বহুদূরের কোনো এক অচেনা নগরীর দেয়াল ঘেঁষে বসে কেউ যেন আমার জন্য, হ্যাঁ, শুধুমাত্র আমার জন্য বাঁশি বাজিয়ে চলছে নিরন্তর। পশ্চিমাকাশের হলদে নীলাভ মেঘের মেল্যানকোলিক একটা সুর তুলে আমার কাছে আসে, আমাকে ভেসে ভেসে কই যেন...কোনো এক দিগন্ত বিস্তৃত রেখা ধরে...একটা অলৌকিক নদীর পাড়ে নিয়ে যায়।
...

সোহেল রহমান: পিএইচডি গবেষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। লিসবন, পর্তুগাল। ইমেইল: <[email protected]>