মনের কালো ধুয়ে যাক

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

জেগে ওঠা ইমারত ঢেকে দিতে চায় কংক্রিটের শহরের মাথার ওপরের আকাশটাকে। সুউচ্চ ভবনের ফাঁকে-ফাঁকে চুরি হয়ে যাওয়া শরতের আকাশের চাঁদ সামাল দিতে পারে না জ্যোৎস্নাকে। ধরা দেয় বাংলো বাড়ির বে-উইন্ডোর পাশে। নীল আকাশের স্নিগ্ধতার মাঝে, যেমন সাদা মেঘের শুভ্রতা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়, মনের আকাশে স্মৃতিগুলোকে তখন, সাদা মেঘের ভেলার মতোই এলোমেলো মনে হয়। নিয়নের আলোয় দেখা জ্যোৎস্না ভরা টরন্টোর আকাশ সে কী আমার?

জীবন ও জীবিকার তাগিদে মহাকাল আজ যেখানে এসে দাঁড় করিয়েছে, সেখানে সবই আছে, কিন্তু অনেক কিছু অচেনা। নেই সেই হ্যাজাকের আধো-আলো সন্ধ্যার মায়াবী মুখ, আশ্বিনের নদী, শীতের পিঠা, নবান্ন, কাশবন, প্রাণের আলাপের কত প্রিয়জন। যা ছিল আমার কাদামাটির দেশে, অশ্বত্থ-বটের দেশে, জল জোছনার দেশে, বৈঠকি উঠানের দেশে। স্মৃতির নোটিফিকেশনে ক্লিক করলে জানান দেয়—‘ইথাক তোকে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছেনারে।’

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

মন সওয়ার হয় সেই আকাশের খোঁজে। যেখানে চাঁদ দেখতাম বাঁশঝোপের ফাঁকে, জ্যোৎস্না ঝরে পড়ত ধসা মাটির দেয়ালে-দেয়ালে, রাতের জোনাকিরা খেলা করত বাড়ির আগাছার ঝোপে। যেখানে শিশিরভেজা শিউলি ঝরে নিশিতের অন্ধকারে, সাদা আর কমলার গালিচায়, ভিজে পায়ে হেঁটে সকাল আসে; আম-কাঁঠালের দেশের শরতের অনন্ত নীল আকাশে।

উৎসবের আকাশ, শারদীয়ার আকাশ। শরতের দেবীপক্ষে ইথারে ভেসে আসে—‘আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবন মন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী উষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।’

এরপর তিনবার শঙ্খধ্বনি, সুপ্রীতি ঘোষের পরিশীলিত কণ্ঠে গাওয়া সেই গান—‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। মাতৃ পক্ষের শুরু।

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

ঘরের ভেতরে বাণী কুমারের রচনায়, পঙ্কজ মল্লিকের সুর, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ আর বাইরে ফজরের আজানের ধ্বনি শরতের আকাশকে আরও জীবন্ত করে তুলত। শস্যশ্যামলা এই দেশটির মানুষেরা নবান্নের পিঠে-পুলি, রাতের আঁধারে লণ্ঠনের আলো জ্বেলে ট্যাটা আর কুচ নিয়ে মাছ মারায় আনন্দে দুলে উঠত; যেমন দোলে শরতের কাশ। কিন্তু শ্যাম-সুলেমানেরা মানুষের এই দেশটাকে কবে যে হিন্দু-মুসলমানের দেশ বানিয়ে ফেলল, তা টেরই পেলাম না। ধর্মান্ধদের কাশের গোড়া ধরে টানাটানিতে মাটিতে চির ধরেছে, চির ধরেছে আমাদের বিশ্বাসে, ভাঙন ধরেছে সমাজের কাঠামোতে। মাটির বুকে দাঁড়ানো আকাশ বাতিটা আজ বড়ই একা; রাত ফুরালে দিনেরা আকাশ-পথ হারায়। ভোটের মাঠে, খেলার ব্যাটে, ধর্মের ক্লেদ সম্প্রীতির সাজানো বাগান তছনছ করে, মানুষের জন্য রেখে গেছে স্লোগান—‘ধর্ম যার-যার, রাষ্ট্র সবার’। আছে শুধু ভাষণে আর অনুষ্ঠান-আচারে, দেখা মেলে না বিচারে।

তবু সেই দেশে, সনাতনী বিশ্বাসীদের কাছে, কাশবনের রাস্তা ধরে-ধরে এখনো মা দুর্গা আসেন বাপের বাড়িতে তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে।

লেখক
লেখক

দেবী তাঁর বাহনে বসে অবাক বিস্ময়ে দেখেন, কী ছিরি! তাঁর মানুষের দেশের? জল ভরা নদী নেই, মাঠ ভরা ধান আছে কিন্তু কিষানির খিলখিল হাসি নেই, রাষ্ট্রীয় অনুদানে বেড়ে চলেছে পূজার আলোকচ্ছটা; তাতে প্রাণের স্পন্দন নেই। মর্যাদার জীবন নেই। সেখানে আজ অজস্র পিশাচের অট্টহাসি আর শয়তানের জ্বলজ্বল চোখের ঘোরাফেরা। এক সময়ের মানুষদের, ডাক টিকিট জমানো, খালে-বিলে ঝাপানো, ঘুড়ি ওড়ানো নেশা বদলে হয়েছে এখন ধর্ষণের নেশা। এর থেকে নিস্তার পায় না শিশু থেকে বৃদ্ধা। এতটুকু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই, স্কুল-কলেজের, পথে প্রান্তরের দুর্গাদের।

শ্যাম-সুলেমান গর্ব করে দেশ এগিয়েছে। তবে মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় আমরা শত বছর পিছিয়েছি। মণ্ডপে মণ্ডপে রাখতে হয় পুলিশি পাহারা, এটিএন বাংলা নিউজ করে, সাংস্কৃতিক মিলনায়তনের নামে অতি উৎসাহী জেলা প্রশাসকের সরকারি অধিগ্রহণের নাম করে মন্দিরের জায়গা হজমের পাঁয়তারা। আগে যত জ্ঞানী-গুণী, কবি-গল্পকার ছিলেন মননে, এখন তাদের নাম, শোভা বর্ধন করে ব্রিজে, কালভার্টে, বিমানবন্দরে। বিস্ময়ের জেটলেগ কাটাতে কাটতে আগমনী দেখেন—‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’। এই অন্ধকার দূরীভূত করতেই দেবী দুর্গার আগমন, মনের পশুত্বকে বধ করে, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বর দেন। পবিত্র মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে তাঁকে পূজা করা হয়। যে মাটিতে শ্যাম-সুলেমানেরা আজও ধূপ আর আতরের গন্ধের ফারাক করতে পারেনি। সে মাটিতে এখনো মায়ের গন্ধ, আছে জীবনের রস। তাই শারদ উৎসবে প্রতিটি মানুষের জীবন শারদ আনন্দে রসসিক্ত হোক। পৃথিবীর সকল মানুষ শান্তির বাতাবরণ পাক। আলোকের ঝরনাধারায় মনের কালো ধুয়ে যাক।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: টরন্টো, কানাডা। ইমেইল: <[email protected]>