শৈশব

সবাইকে গল্প পড়ে শোনানো হচ্ছে
সবাইকে গল্প পড়ে শোনানো হচ্ছে

ইতালির বলনিয়া শহরের অদূরে, শহুরে কোলাহল থেকে একটু আড়ালে গড়ে ওঠা একটা ব্যতিক্রমধর্মী স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ইতালিয়ান ভাষায় সেই স্কুলের নাম ‘i passerotti’ বাংলায় ‘চড়াই পাখি’। এটা একটা আউটডোর স্কুল। এই স্কুলের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে চার দেয়ালের মধ্যে কোনো ক্লাস নেওয়া হয় না। নির্দিষ্ট কোনো সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয় না। যেমন খুশি তেমন করো স্কুল। অন্যান্য স্কুলের মতো এটাও সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক থেকে ছয় বছর বয়সে যা যা করতে ভালো লাগে বা যা করতে ইচ্ছা করে সেসব করার সব উপকরণই আছে এখানে। এখানে কোনো কিছু করতে সাধারণত না বলা হয় না। ভালো মন্দ দুই দিকই বলে দেওয়া হয়। তারপর তাকে পছন্দ করতে দেওয়া হয় সে কোনটা চায়।

দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেলে নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করে উঠে দাঁড়াতে। মারামারিও যে করে না তা নয়। নিজেরাই আবার সরি বলে কোলাকুলি করে নেয়। একজন কাঁদতে শুরু করলে তিনজন ছুটে আসে থামাতে। মন চাইলে ফুটবল খেলে, মন চাইলে সাইকেল চালায়। মন চাইলে গাছে চড়ে। মন চাইলে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। মন চাইলে পানি নিয়ে খেলে। এরা স্কুল টাইমে সবজি চাষ করে। মুরগি পালে। এদের অভিভাবকেরা তাদের অবসরে এসে তাদের সঙ্গে কাজ করেন। মনোবিজ্ঞানীরা খেয়াল করেছেন, ছোট বাচ্চারা বাবা–মায়ের আদেশ নিষেধ মুখে শোনার থেকে বাবা মাকে অনুসরণ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর এ কারণেই হয়তো এই ব্যবস্থা।

প্রতিদিন তারা ইশপ থেকে রূপকথা সব ধরনের গল্পই পালা করে শোনে তাদের শিক্ষকের থেকে। যার ছবি আঁকা ভালো লাগে সে ছবি আঁকে, যার গান বাজনা ভালো লাগে সে সেটা করে। মনের মধ্যে থেকে প্রতিযোগিতা বা কাউকে নিচে ফেলে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে, এই মনোভাব থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা চলে সব সময় এখানে। জুতার ফিতা খুলে গেলে দৌড়ে শিক্ষককে বলে বেঁধে দিতে, মন চাইলে দৌড়ে এসে শিক্ষককে জড়িয়ে ধরে বা চুমু দিয়ে আবার দৌড়। মীক্ষক–শিক্ষার্থীর এই সম্পর্ক থেকেই সম্পর্কের মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। প্রতিদিন নানা অ্যাকটিভিটিস থাকে যেগুলো একা বা গ্রুপে করতে হয়। এখান থেকেই এরা নানা কিছু শেখে। বলা চলে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার হাতেখড়ি। এসব অভিভাবকেরা চান প্রকৃতির সঙ্গেই যেন বেড়ে ওঠে তাদের সন্তান। এ রকম আরও অনেক বৈশিষ্ট্যই আছে এই স্কুলের।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্টেফানিয়ার সঙ্গে লেখক
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্টেফানিয়ার সঙ্গে লেখক

এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা স্টেফানিয়া। তিনি জার্মানি থেকে এই এই ধরনের স্কুলের কারিকুলাম নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করার পর এই স্কুল চালান। তিনি বলেন, ‘সন্তানের সুস্থ ও সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রকৃতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান! তাই আমরা চাই প্রকৃতির সঙ্গেই হোক আমাদের পথচলা। প্রকৃতির মাঝেই শিশুরা অবলোকন, প্রতিফলিত ও কল্পনা করতে শেখে। তারা শেখে অপেক্ষা করতে এবং যত্ন নিতে। এই স্কুলে আমরা বিশ্বাস করি খারাপ আবহাওয়া বলে কিছু নেই। সাময়িক কিছু কাপড় নোংরা হওয়া ছাড়া কোনো কিছুই ভয়ংকর নয়। বৃষ্টি বা রোদ, তুষার বা ঝড় বাতাস সবকিছু মোকাবিলা করার মতো সামর্থ্য আমাদের থাকা উচিত। প্রকৃতির মাঝে থেকেই দায়িত্বশীল, সচেতন, বিবেকবান, স্নেহপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য হয়েই বেড়ে ওঠে, যেটা কিনা অনেক সময় বড়দেরও শিক্ষা দিয়ে থাকে।’

নরওয়ে, সুইডেন থেকে শুরু করে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি সবখানেই এই আউটডোর স্কুলের কনসেপ্ট খুব দ্রুততার সঙ্গে সমাদৃত হচ্ছে। শুধু ইউরোপ–আমেরিকা নয়, এমনকি জাপান, সিঙ্গাপুরেও ছোটদের জন্য নির্দিষ্ট সিলেবাসে পরীক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দিচ্ছে। মানুষকে মূল্যায়ন, সম্পর্কগুলোকে অনুধাবন, মানবিকতা, সহনশীলতা বা শিষ্টাচার এগুলোর প্রতি তারা ছোট বয়স থেকেই যেন যত্নবান হয় সেটার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।

অথচ আমাদের দেশে বর্তমানে ‘অতি সচেতন’ এক অভিভাবক শ্রেণি তৈরি হয়েছে যারা সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়াবহ রকমের সিরিয়াস। দৌড়ালে পড়ে যাবে, রোদে গেলে বা বৃষ্টিতে ভিজলে অসুস্থ হবে। এইটুকুন বয়সে ১০ ঘণ্টা না পড়লে বা চার–পাঁচটা টিউটর না দিলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এ রকম তুলুতুলু করা নিয়ে ব্যস্ত। তার ওপর আবার যোগ হয়েছে স্মার্টফোন বা ট্যাবের আদিখ্যেতা। স্মার্টফোনে গেম খেলতে না দিলে বা ভিনদেশি ভাষার কার্টুন না দেখতে দিলে খায় না। শহুরে জীবন আর ইন্টারনেটের প্রভাব পরের প্রজন্মকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করে বেড়ে তুলবে। প্রযুক্তির এই যথেচ্ছ ব্যবহার খারাপ বই ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

আমার আফসোস হয় এই ভিডিও গেমস আর নানা আদিখ্যেতার চাপে এরা চাঁদমামা, চাঁদের বুড়ির খোঁজ পাবে না কখনো। রাজার কুমার, কোটাল কুমার, পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কথা জানবে না কখনো। কাজলা দিদির কথা শুনবে না, জোনাকি পোকাও কখনো দেখবে না। আলাদিন আর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্প শুনবে না কখনো। বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটির গন্ধ পাবে না কখনো। পুকুরে বা নদীতে পা দাপিয়ে সাঁতরানোর আনন্দ পাবে না কখনো। জ্যৈষ্ঠ মাসে আম কুড়ানোর মজা পাবে না কখনো। গ্রামের মেলায় হাওয়াই মিঠাইয়ের স্বাদ পাবে না কখনো।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষা সমস্যা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন-‘শিখিবার কালে, বাড়িয়া উঠিবার সময়ে, প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই। গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত বায়ু, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্য-ইহারা বেঞ্চি এবং বোর্ড, পুঁথি এবং পরীক্ষার থেকে কম আবশ্যক নয়।’

আমার খুব প্রিয় নচিকেতার একটা গানের লিরিক দিয়ে শেষ করি—

‘ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে
চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনারোদ
ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থ কীটের দল বানায় নির্বোধ।’
...

মো. মোহাম্মদ মেজবাহুল হক: University of Bologna, Bologna, Italy. <www.mezba.info>