বেকারত্বের কারণ কী আমাদের মানসিক দৈন্য?

প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি

একটা ছোট্ট খবর দেখে বেশ অবাক হয়েছি। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ও যুক্তরাজ্য থেকে গ্র্যাজুয়েট করে আসা এক ভদ্রলোক গ্রামে গিয়ে মাছের চাষ ও গরু ছাগলের খামার করছেন। যেটায় তার সাধারণ চাকরির চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে তিনি সরাসরি অবদান রাখছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ এক বিরল ঘটনা। আমাদের চিন্তাভাবনায় অনেক ধরনের সমস্যা ও দৈন্য আছে। তার মধ্যে একটি অন্যতম সমস্যা হলো আমরা মানুষের মূল্যায়ন করি তার সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। আর সেই সামাজিক অবস্থান নির্মিত হয় সম্পূর্ণভাবে তার পেশা ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরে। যেভাবে শিক্ষার মূল্য দেওয়া উচিত, সেভাবে শিক্ষার মূল্য না দিয়ে শিক্ষাকে মূল্য দিই সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ভুলভাবে। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। মনের প্রসারতা বাড়ায়। জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে। এসব আমাদের কাছে গৌণ। আমরা চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হোক শুধুমাত্র একটা ভালো চাকরি লাভের উদ্দেশ্যে।

ভালো পেশা মানেই আমাদের কাছে ভালো চাকরি ও টেবিল চেয়ারে বসে করা কাজ। অন্য কোনো কাজকে আমরা 'চাকরি' বলতেই নারাজ, ভালো পেশা হিসেবে সম্মান দেওয়া তো দূরের কথা। আমরা বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে শেখাই রিকশাওয়ালা মানে গালি, গার্মেন্টসের মেয়ে মানে রুচিহীন ও অশিক্ষিত। সমাজের এই শ্রেণি বিভাগের কারণে কী লাভ হয়েছে সেটা আমাদের চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেই বুঝবেন। সম্মানের জন্য সবাই টেবিল-চেয়ারে বসে তথাকথিত অফিসের চাকরি করতে চান। না হলে জাতে ওঠা যাবে না।

কৃষক, জেলে, দিন মজুর, রাজমিস্ত্রি, বিভিন্ন যানবাহনের চালক, নার্স, মেথর, ধোপা, কারখানা শ্রমিক, গার্মেন্টসের কর্মী ও দোকানি, যাদের ছাড়া দেশ অচল, যারা আমাদের নিত্যদিনের চাহিদার বিভিন্নভাবে রসদ জোগান তাদের সামাজিক অবস্থান অনেক অনেক নিচে। গ্রামে থাকা মানুষদের আমরা এখনো করুণার চোখে দেখি। এ কারণে এসব পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে।

ছোটবেলা থেকেই দেখছি গ্রাম থেকে বিভিন্ন আত্মীয়, অনাত্মীয় ঢাকায় আসেন চাকরির খোঁজে। কোনো রকমে ছেলেকে এসএসসি পাস করিয়েই আমাদের বাসায় আমার বাবা–মায়ের কাছে চাকরির সুপারিশ নিয়ে পাঠিয়ে দিতেন সবাই। স্বাভাবিক ভাবেই এই বিদ্যা নিয়ে কতটুকু ভালো কাজই বা পাওয়া যায়? তারপরেও তারা কেউ গ্রামে থাকবেন না। খেয়ে না খেয়ে, কষ্ট করে হলেও ঢাকা শহরের আনাচকানাচে পরিবার নিয়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন এরা। এতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হচ্ছে আর ঢাকার ওপরে চাপ বাড়ছে অকল্পনীয়। বিশ বছর আগের ঢাকা আর বর্তমান ঢাকার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই শহর হয়ে পড়েছে বসবাসের অযোগ্য। তার চেয়েও বড় কথা, এত বেশি টেবিল চেয়ারে বসা চাকরি কোথায়? সবাই চেয়ারে বসে থাকলে উৎপাদনমূলক কাজগুলো করবেন কে? ছোটবেলা থেকেই জানি, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিকাজ কী চেয়ার টেবিলে বসে করা সম্ভব? দেশে যদি কিছু উৎপাদন না হয়, আর সবাই খালি বসে বসে খায় তাহলে তো খাওয়ায় টান পড়বেই।

সময় এসেছে এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। একজন কৃষক বা শিল্পকারখানার শ্রমিক বা দিনমজুর সবাইকে যেন আমরা মানুষ হিসেবে সমান সম্মান করি। চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরার জন্য বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাল ভরা অপ্রয়োজনীয় ডিগ্রি নিয়ে ঢাকা শহরে আরেকজন বেকার সংখ্যা বাড়ানো মানে আরেকটি জনশক্তির অপচয় ও দেশকে একধাপ পিছিয়ে দেওয়া। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে এই জনশক্তিকে সত্যিকার শক্তিতে পরিণত করতে হবে। তবেই দেশের বেকারত্ব ঘুচবে।