বাচ্চু ভাই, গিটার এখনো পোড়ায়

সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু
সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু

বাচ্চু ভাই, আমার কোনো ‘ভক্ত তারকা’ ছিলেন না। তারকা ভক্তি বিষয়টা ঠিক আমার জন্য নয়। শিল্পীদের গান, অভিনয় আমি ভালোবাসি। তাদের ভালোবাসি। কিন্তু সহজে কারও ভক্ত হতে পারি না। আমার তারকারা হলেন বিজ্ঞানীরা। আমার নায়কেরা হলেন দুনিয়াখ‍্যাত বিজ্ঞানী। কিন্তু বাচ্চু ভাই, আপনি শুধু ব্যতিক্রমী হয়ে ছিলেন। কী করে আপনার প্রতি ভক্তি জেগেছিল, তা জানা নেই। কী করে আপনি ভক্ত তারকা হয়ে গেলেন, টের পাইনি।

আমার কৈশোর কেটেছে গ্রামে। নিরেট গ্রামে। কী করে সেই নিরেট গ্রামে আপনার কণ্ঠ পৌঁছেছে, আজ মনে নেই। আপনার ‘কষ্ট’ অ্যালবাম বের হলো। সেই ক‍্যাসেট কিনলাম। ঘরের পুরোনো টেপ রেকর্ডারে টেনে টেনে গানগুলো বারবার শুনতাম। আমাদের টিনের ঘরে, প্রবল বর্ষণের শব্দের সঙ্গে আপনার গিটারের শব্দেরা কী যে সিনক্রোনাইজ করত—সে অনুভূতি বোঝানোর নয়। সেই শব্দগুলো মগজ খুঁড়ে খুঁড়ে গভীরে ঢুকতে লাগল। প্রত্যন্ত গ্রামে বসে, আমি গিটার শেখার ও গিটার বাজানোর স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। সে স্বপ্ন দিনে দিনে আমাকে শুধু তাড়াতে লাগল। যন্ত্রণা দিতে লাগল। কিন্তু কী করে মাকে বলি—একটা গিটার কিনে দাও। মা তো সংসারের টানাপোড়েনে দিন-রাত যন্ত্রণার মধ‍্য দিয়েই যাচ্ছেন। সেখানে গিটার কেনার মতো যথেষ্ট অর্থ নেই। আবহ নেই। গিটার সেখানে এক অনেক বিলাসী বিষয়! তা ছাড়া, যে বংশের কেউ কোনো দিন সংগীত করেনি, সেখানে গিটার বাজানোর ইচ্ছে প্রকাশ ছিল এক গর্হিত অন্যায়!

কলেজে গেলাম। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। আপনি এলেন আমার কলেজে। উজাড় করে গাইলেন। সেই প্রথম দেখা। প্রথম তারুণ্যে উন্মাদের মতো আপনার গানের সঙ্গে নাচলাম। কষ্ট, স্বপ্ন, ফেরারি মন-এই তিন অ্যালবাম দিয়ে আপনি বছর দুইয়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। টাকা জমিয়ে ব‍্যান্ডের ক‍্যাসেট কিনতাম। দোকানির সঙ্গে খাতির করে, ক‍্যাসেটের সঙ্গে পোস্টার নিতাম। গানগুলো মুখস্থ করতাম। আহা, ক‍্যাসেটের সেই সোনালি দিনগুলো! কুমিল্লায় খুব সীমিত কয়েকটি দোকানে গিটার দেখা যেত। যদিও মানের দিক দিয়ে সেগুলোকে গিটার বলা যায় না। তবুও দেখতে যেতাম। নাড়াচাড়া করতাম। কেনার সাধ্য ছিল না, বাচ্চু ভাই।

এই করে করে, কলেজ শেষে ইউনিভার্সিটি গেলাম। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত উত্থান-পতন এল। কত কিছু বদলে গেল। কিন্তু জানেন, সেই গিটারের টানটা বদলায়নি এতটুকু। গিটারের স্বপ্ন আমাকে ছাড়েনি সামান‍্যও। ইউনিভার্সিটির হলের পত্রিকা রুমে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে, আনন্দলোক (সম্ভবত) ম‍্যাগাজিনের গিটার পাঠ। আপনি আর বাপ্পা মজুমদার সেই পাতায় গিটারের পাঠ দিতেন। চুরি করে সেই পাতা আমি নিয়ে নিতাম। আমি জানতাম, হলের কেউ আর সেই পাতাটা পড়বে না। পাঠগুলো জমিয়ে রাখতাম এই আশায় যে, একদিন গিটার কিনে শিখে নেব সব! তারপর আস্তে আস্তে কিছু টাকা জামালাম। এবার একটা গিটার কিনবই। কিন্তু গিটার কিনে কী করে বাজাব! কাউকে তো চিনি না। কে শেখাবে আমাকে? এই করে করে আরও বহুদিন চলে গেল। খুঁজে পেলাম ইউনিভার্সিটির এক বড় ভাই—শাহরুখ তার নাম। গিটারে তার জ্ঞান কয়েকটি কর্ড পর্যন্তই। সারা দিন তিনি নানান কাজে ব্যস্ত থাকতেন। আমাকে কখন শেখাবেন তিনি। রাতে তার লালখান বাজারের মেসে যেতাম। ওনার জন্য সঙ্গে কয়েকটা বেনসন সিগারেট নিতাম। তিনি ধূমপান করতেন। সিগারেট পেয়ে খুশি হতেন। সিগারেট টানতে টানতে আমাকে নিয়ে বসতেন। কয়েকটা নোট (স্বর) দেখিয়ে দিতেন। রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত। হাই তুলতে তুলতে বিদায় দিতেন। এভাবে কী গিটার শেখা হয়, বলুন!

তারপর, শাহরুখ ভাইকে নিয়েই আন্দরকিল্লার ‘গণেশ অ্যান্ড কোং’ থেকে একটা গিবসন গিটার কিনে ফেলি। প্রথম গিটার কেনার উত্তেজনা, প্রথম প্রেমের চেয়ে বেশি ছিল—কেউ জানেনি কখনো। কেউ না! এরপর একদিন পরিচয় হয়ে যায় চঞ্চল মাহমুদ নামের একজন গিটারিস্টের সঙ্গে। তিনি আপাদমস্তক শিল্পী। মেধাবী। গুণী। কিন্তু অনিয়মিত। সময়জ্ঞানের অভাব ছিল যথেষ্ট। তার মেধাকে ভালোবাসলাম। তার কাছে শেখা শুরু করলাম। আমি তাকে ছাড়লাম না। তিনিই আমাকে ছেড়ে চট্টগ্রাম থেকে চলে গেলেন ঢাকায়, র‍্যাংকিন স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে। তারপরও, গিটারের যে সামান‍্য সারগাম শেখা, সেটা চঞ্চল মাহমুদের কাছ থেকেই। তার প্রতি তাই ভক্তি ছিল নিরন্তর।

এই করে করে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন প্রায় শেষ। নিজের একটা জীবন নতুন শুরু হতে লাগল। উচ্চতর গবেষণার জন্য চলে এলাম স্টকহোমে। কিন্তু গিটার প্রেম আমাকে ছাড়ল না। স্টকহোমে গিয়েও গিটার নিলাম। সুইডেন থেকে আমেরিকা এলাম। এখানে এসেও একটা নতুন গিটার কিনলাম—ইয়ামাহা। গিটার আমাকে ছাড়েনি কখনো। অনেক দামি গিটার কেনার সাধ্য আছে এখন, কিন্তু কৈশোরে একটা গিটার না পাওয়ার যে দুঃখটা, সেটা এখনো মুছে যায়নি। গিটার ভালো বাজাতে না পারার কষ্টটুকু এখনো পোড়ায়। এখন সাধ্যের সঙ্গে সময়ের দ্বন্দ্ব! গিটার হাতে নিলে আবেগী হয়ে যাই। গিটার আমাকে উদাসী করে। গিটার আমাকে আজও পোড়ায়, বাচ্চু ভাই। কেন জানি না। আপনার কী জানা আছে?

খুব ইচ্ছে ছিল, মনের গভীরে জমানো এই সব কথাগুলো আপনার কাছে কখনো বসে শোনাব। আপনি হয়তো বুঝতেন সে ব্যথা। আপনি হয়তো বুঝতেন কী করে গিটার কাউকে বিবাগি করে, উদাসী করে। কী করে গিটার অশ্রু ঝরাতে পারে। বলার সুযোগ হলো না। কাউকে কোনো দিন না বলা কথাগুলো আজ বলে দিলাম। জানি না আপনি পড়বেন কিনা! যদি পড়ে থাকেন, তাহলে কোনো এক কার্তিকে নবান্নের দেশে, রক্তিম সন্ধ্যায় বিকেলের ঝিরঝির বাতাস হয়ে এসেন। গাইব একসঙ্গে। দুঃখকে ভাসিয়ে দিয়ে।
...

ড. রউফুল আলম: রসায়ন গবেষক। ইমেইল: <rauful.alam15 @gmail.com>; ফেসবুক: <rauful15>