হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-ছয়

এই নীল টুপি ক্রাচ কন্যা নির্জলা গুল মারছে কিনা কে জানে। আমি যেরকম গবেট ধরনের, তাতে যে কেউ ঢালাওভাবে গুল মেরে পার পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু গুল হোক আর নাই হোক, খুব জানতে ইচ্ছা করছে, লতা টুকটাক কোনো বাংলা শিখে এসেছে কিনা। চোখের তারায় কৌতূহলের ঝিলিক দেখে লতা ভুল-ভাল উচ্চারণে যে বাক্যটা বলল, তাতে আমার পিলে চমকে গেল। পিলে কেন, পিলেদের বাপ-দাদারা থাকলে তারাও চমকাতেন। কই আমি ভাবছি সে ‘অ্যাই মামা, জিগাতলা যাবা?’ ধরনের কিছু একটা বলবে, তা না বলে লতা খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘হাফ কেজি করাল্লাহ্ ডাও। টিটাহ্ ডেখে।’ এর চেয়ে যদি বলত, ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ তাহলেও এত ভড়কে যেতাম না। লতার টিটাহ্ করাল্লাহ্ আমাকে নিমেষে ঘায়েল করে ফেলল। হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ার দশা। লতা সামান্য আহত হয়ে তাকাল। তাতে হাসি চওড়া হয়ে এ কান-ও কান হয়ে গেল। কোক পড়ে তখনো আধভেজা শার্টের বুকপকেট চেপে হাসতে থাকলাম।

খুব এক দফা হেসে যখন ভালো করে চোখ মেললাম, দেখি লতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কী যেন দেখছে। তার চাহনির হদিস করতে গিয়ে দেখলাম, দৃষ্টিটা আমার দিকেই। অস্বস্তিতে পড়লাম। এই মেয়ে তো বাঙালি মেয়ের মতো চোখে চোখ পড়তেই পলক সরিয়ে ফেলছে না। বরং তাকিয়েই আছে। ভালো জ্বালা তো! একে কী ফ্রাউ ক্যাথরিনের রোগে ধরল নাকি? খুক করে কেশে লতার ধ্যান ভাঙানো চেষ্টায় বললাম, ‘এত কিছু রেখে করল্লার পিছে লাগলে কেন?’ বলেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। আপনি থেকে অনুমতিবিহীন তুমিতে চলে গিয়েছি। কিন্তু মনে হলো, ধ্যাত, গুল্লি মারি এই আপনি-তুমির ফাউ শিষ্টাচারে। বলেছি, বেশ করেছি।

লতার উত্তরে করল্লার বিহাইন্ড দ্য সিন জানা গেল। তাদের ডাক্তারি দলটা ভোর সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আন্ডা-বাচ্চা, ছাও-পাওদের টিকা দেওয়ার কাজ করেছে। আর ফেরার পথে প্রায় প্রতিদিন সে ক্যাম্প লাগোয়া কাঁচাবাজারে গিয়েছে। তারপর রেস্ট হাউসে ফিরে সেখানের কিচেনে সবজি-টবজি সেদ্ধ কী হালকা তেলে ভেজে খেয়েছে। এই জার্মানগুলো পারেও বটে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক, কারও আশায় বসে না থেকে এরা নিজেদের মতো সব গুছিয়ে নিতে জানে। আরও জানা গেল, করল্লা ছাড়াও এই পাগল মেয়ে প্রচুর পরিমাণে পটল, ঢ্যাঁড়স, কাঁকরোল ইত্যাদি সাবাড় করে দিয়ে এসেছে। যা যা সে এই খটমট জার্মান দেশে কোনো দিন দেখেনি, তার সবটার স্বাদই সে আমাদের বঙ্গদেশে গিয়ে নিয়ে এসেছে।

ওদিকে লতা হাত নাচিয়ে মহানন্দে বলেই চলছে, ফিরে আসার আগের দুই দিন সে ঢাকায় এক ডাক্তার বন্ধুর হোন্ডার পেছনে বসে খুব ঘোরা ঘুরেছে। পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা সব তার মুখস্থ। আমি আর বিস্ময় লুকিয়ে রাখার জায়গা পেলাম না যখন লতা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, তার বাংলাদেশ ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ঠাটারিবাজারে স্টারের কাচ্চি বিরিয়ানি। সেটা এক চামচ করে খেয়েছে আর কেঁদেছে। তারপর ঠান্ডা পানি গিলে পরের চামচটা মুখে নিয়েছে। যদিও ঝালের জ্বালায় সে পাঁচ-ছয় চামচের বেশি এগোতে পারেনি, কিন্তু তার কাছে নাকি মনে হয়েছে কাচ্চি একটা বেহেশতি খাবার। আমি লতার তারিফ শুনে বলেই ফেললাম, ‘অবশ্যই বেহেশতি খাবার। প্লেটের পর প্লেট কাচ্চি নামিয়ে কোলেস্টেরলের পারদ উঁচিয়ে পটল তুলে ফেললে তো আসলেই বেশ শর্টকাটে বেহেশতে পগার পার হওয়া যায়। তখন আঙুল হেলালেই সুন্দরী হুর পরি কিংবা সুদর্শন গেলেমান থালা কে থালা মৌ মৌ কাচ্চি নিয়ে হাজির হবে। তখন মজার ওপর মজা।’ অবশ্য, এখানে লতাকে হুর পরি আর গেলেমান সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা দিতে হলো। শুনে–টুনে লতা রীতিমতো ক্যাফে কাঁপিয়ে হাসল। সত্যি বলতে, এর আগে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কারও সঙ্গে এমন সহজভাবে কথা বলে আরাম পাইনি।

কফি ধোঁয়ায় বেশ কাটছিল সময়টা। উদ্ভূত লতা আর তার যত অদ্ভুতুড়ে গল্প। ওয়েটার ব্যাটার বিল নেবার তাড়ায় আমরা নড়ে চড়ে বসলাম। যে যার বিল মিটিয়ে দিলাম কোনো রকম দ্বিরুক্তি ছাড়াই। কারণ, জানি বাধা দিয়ে লাভ নেই। জার্মান এই কুলটুর (কালচার আর কী) আমার ভালোই লাগে। হিজ হিজ হুজ হুজ। যার যার তার তার। নিজেরটা দিয়ে থুয়ে কিছু মিছু থাকে। পকেট একেবারে গড়ের মাঠ হয়ে যায় না।

বাইরে আগস্টের তুমুল দুপুর। বাড়িঘর-দোকানপাটের জানালায় ছোট ছোট টেবিল ফ্যান ঘুরছে। সূর্য নেমে এসেছে ঘাড়ের ওপর। বেগতিক দেখে লতার নীল টুপি হাতব্যাগে গা ঢাকা দিয়েছে। সুযোগ পেয়ে শাসন ছেড়ে নেমে আসা সোনালি চুলে অন্যমনস্ক লতাকে মনে হচ্ছে যেন বহুদূরের কোনো ভিনগ্রহের অচিন মানবী। চাইলেও যাকে চেনা দায়। এক মুহূর্তের জন্য মুখ থেকে কথা হারিয়ে গেল আমার।

শূন্যে হাতড়ে কোনোমতে গোটা কয়েক কথা খুঁজে পেলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এবার যে বাড়ির পথ ধরতে হবে। ভালো লাগল কথা বলে। সাবধানে চললে ভালো হয়। এদিকে তো বাস-ট্রাম কিছু নেই। যেতে অসুবিধা হবে না তো?’ কথাগুলো অনেক চেষ্টা করে আপনি-তুমি এড়িয়ে বললাম। লতা হাত দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে জানাল, তার বাসা খুব কাছেই। মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। আমার কাছেপিঠে কোথাও থাকা হয় কিনা। খেয়াল করলাম, তার কথাতেও আপনি-তুমি ঊহ্য।

রাস্তার ওপাশের গির্জাটার পাশের বাড়ির তিন তালায় আমার রাজত্ব। সঙ্গে এক চীনা আর রাশিয়ান শরিকও আছে। শুনে লতা প্রস্তাব দিল, এত কাছেই যখন থাকা হয়, তখন সপ্তাহ দুই পরের শনিবার বিকেলে যাব নাকি তার সঙ্গে নদীর পাড়ে হাঁটতে। তত দিনে নাকি তার প্লাস্টার, মেডিকেল বুট ইত্যাদি থাকবে না। কিন্তু রুটিনমাফিক মিনিট চল্লিশেক হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করতে হবে। ভাবলাম, সামনের মাসের চাকরিটা শুরু হওয়ার আগে এ মাসের বিকেলগুলো এমনিতেও অলস বসে কাটত। তা ছাড়া, হুল্লোড়প্রিয় চাইনিজ আর রাশিয়ান রুমমেটদের সঙ্গে আমার মুখচোরা স্বভাবের কারণে ‘কী খবর, কেমন আছ’-এর” বাইরে তেমন একটা উঠ-বস নেই। অন্য বন্ধু-বান্ধব হয় পড়াশোনা, নয় চাকরির ধান্দায় ব্যস্ত। খালি আমিই আপাতত অবসর। তা ছাড়া পুরো মিউনিখের ভেতর এই ইজার নদীর পাড়টা আমার প্রিয় একটা জায়গা।

ঠিক হলো এই শনিবারের পরের শনিবার বিকেল পাঁচটায় নদীর দক্ষিণ পাড়ের সেতুটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকব। লতা ঠিক ঘড়ি ধরে পৌঁছে যাবে। মুঠোফোন নম্বর চালাচালির এই অস্থির যুগে মুখের কথার এই বন্দোবস্তটা আমার মনে ধরল। এর ভেতর একটা অনিশ্চয়তা আছে। আর জগৎটাই তো হাইজেনবার্গ সাহেবের অনিশ্চয়তার সূত্র দিয়ে ঘেরা। বেগ ঠিক থাকে তো অবস্থান ঠিক থাকে না। কিংবা উল্টোটা। দেখে যাক, শনিবারে নদীর পাড়ে লতার অবস্থান কেমন থাকে। হাত নেড়ে হেসে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালাম বাড়ির পথে। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন